দেশে বেড়েছে প্রায় সব পণ্যের দাম। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ধীরে ধীরে বেশিরভাগ পণ্যের দাম পড়লেও দেশে শুধু বাড়ছে। গরিব-নিম্ন-মধ্যবিত্ত সব পেশার মানুষ এখন সংকটে আছে।
বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম ৬ থেকে ১৯ শতাংশ বাড়লেও দেশে বেড়েছে ১০ থেকে ৬৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক ও দেশের পণ্যবাজারের দামের এমন ব্যবধানের ছবি উঠে এসেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে রয়েছে বিভিন্ন পণ্যের বর্তমান চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির বিস্তারিত তথ্য।
এদিকে উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের দাম বাড়ার কারণে কিছু খাতের ব্যবসা লোকসানে রয়েছে। এ ছাড়া কিছু সিন্ডিকেট ও মজুতদারের কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে এখন বিশ্ববাজারে দাম কমছে, ভোক্তারা এর সুফল পাবেন আরও দেড় থেকে দুই মাস পর।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইআইটি) এ কে এম আলী আহাদ খান জানান, বিশ্ববাজার পরিস্থিতির সঙ্গে দেশের বাজারে নিত্যপণ্যসহ অন্য জিনিসপত্রের দাম সমন্বয় করার দায়িত্ব ট্যারিফ কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে তিন-চার দিন আগে বৈঠক হয়। বিশ্ববাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে তাদের ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা বিচার-বিশ্নেষণ করে দেশের বাজারে পণ্যের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হবে।
বিশ্ববাজারের চেয়ে চালের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ, আটা ৮ গুণ: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল এক বছরে বিশ্ববাজারে সরু চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ, তবে দেশে বেড়েছে ১৩ শতাংশ। মাঝারি চালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৭ শতাংশ বাড়লেও দেশে বেড়েছে ১০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম। বিশ্ববাজারে এই মানের চালে দাম বেড়েছে ৭ শতাংশের কিছু বেশি। বিপরীতে বাংলাদেশে বেড়েছে ১৯ শতাংশ। তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, এক বছরে বিশ্ববাজারে গড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। তবে দেশে বেড়েছে দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১৪ শতাংশ।
একইভাবে আটার দামেও দেখা গেছে বড় উল্লম্ম্ফন। এক বছরে আটার দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে ৮ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে বেড়েছে এর ৮ গুণের বেশি, অর্থাৎ ৬৭ শতাংশ।
উৎপাদনকারীরা বলছেন, চালের দাম বাড়ার পেছনে মূল কারিগর কিছু সিন্ডিকেট ও মজুতদার। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এইচআর খান পাঠান সাকি বলেন, মিল মালিকরা ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে আড়তদারদের মোটা চাল সরবরাহ করে। সেই চাল পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা হয়ে তিন হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে যায়। ফলে দাম বেড়ে যায়। তবে এত দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই।
মসুর ডাল, পেঁয়াজ ও চিনির দামে উল্টো বাঁক: মসুর ডাল, পেঁয়াজ ও চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। তবে বাংলাদেশে দাম না কমে উল্টো অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে ডালের দাম গড়ে কমেছে ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে বড় দানার মসুর ডালের দাম ৩৯ শতাংশ এবং মাঝারি ও ছোট দানার ডালের দাম প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। গত এক বছরে দেশে ৯ শতাংশ দাম বেড়েছে পেঁয়াজের, যা বিশ্ববাজারে কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে গড়ে দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ। এ সময় দেশে চিনির দামও বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। অথচ বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ।
ভোজ্যতেলের দামে বড় খেলা: এক বছরের বেশি সময় ধরে অস্থির থাকা ভোজ্যতেল নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, গেল পাঁচ বছরে খোলা তেলের লিটারে ৭৫ টাকা ৫০ পয়সা এবং বোতলজাত তেলে ৮৩ টাকা ২৫ পয়সা দাম বেড়েছে।
আটা, মসুর ডাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের দামের ফারাকের ব্যাপারে একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী জানান, গম আমদানিতে বেঘাত ঘটার কারণে আটা-ময়দার দাম বেড়েছে। সামনে গম আমদানিতে সংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দেশে এখন যেসব আমদানি করা নিত্যপণ্য বেচাকেনা হচ্ছে, সেগুলো অন্তত দুই-তিন মাস আগের আমদানি করা। তবে বিশ্ববাজারে যেহেতু এখন খাদ্যপণ্যের দাম কমছে, দেশেও কমবে। সে জন্য দেড় থেকে দুই মাস অপেক্ষা করা লাগতে পারে।
রডের দাম বিশ্ববাজারে কমেছে ১৪ শতাংশ, দেশে বেড়েছে ১৬ শতাংশ :নিত্যপণ্য, জ্বালানি তেলের পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার চিত্র তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। দেশে এসএম রডের চাহিদা রয়েছে ৮০ লাখ টনের, যার সিংহভাগই উৎপাদন হয় দেশে। বিশেষায়িত কিছু রড আমদানি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ৬ লাখ টন। এ বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববাজারে রড উৎপাদনের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ স্টিলের দাম বাড়লেও গত জুলাইতে তা কমে দেড় বছর আগের অবস্থানে ফিরে যায়। জুলাইয়ে কমে প্রতি টনের দাম ৪০০ ডলারের নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ গত এক বছরে বিশ্ববাজারে রডের দাম কমেছে ১৪ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে দাম না কমে বরং বেড়েছে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ।
সিমেন্টের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ: দেশে বছরে ৩৩৬ লাখ ৫০ হাজার টন সিমেন্টের ব্যবহার হয়, যার সিংহভাগই স্থানীয়ভাবে আমদানি হয়। রডের মতো বিশেষায়িত কিছু সিমেন্ট আমদানি হয়। । প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে এক বছরে দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তবে দেশে বেড়েছে ৩১ শতাংশ।