মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১২ পূর্বাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

৩০ বছরের পুরনো চট্টগ্রামের প্রমোদতরী ‘বে ওয়ান’ আয়ু হারিয়েছে ৪ বছর আগে, ঘটনা তদন্ত করবে নৌ বাণিজ্য দপ্তর

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

চট্রগ্রাম প্রতিদিন:

১৯৯২ সালে তৈরি ৩০ বছরের পুরনো জাহাজ সালভিয়া মারুকে (আইএমও নম্বর ৯০৫৪০৮০) চট্টগ্রামে এনে ঘষামাজা করে বানানো হয় বিলাসবহুল প্রমোদতরী ‘বে ওয়ান ক্রুজ’। চট্টগ্রাম-সেন্টমার্টিন নৌরুটে এই জাহাজ চললেও মাঝপথে ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার পথে একটি ইঞ্জিনে আগুন লেগে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জাহাজটিতে। আগুন নিভে যাওয়ার পর আবার সেন্টমার্টিন নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু যাত্রীরা জাহাজটিতে করে আর সেন্টমার্টিন যেতে রাজি হননি। পরে চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ গিয়ে ‘বে ওয়ান ক্রুজ’কে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপকূলে নিয়ে আসে।

শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) মধ্যরাতে চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার পথে ইঞ্জিনে আগুন লেগে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ নামের জাহাজটিতে।
শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) মধ্যরাতে চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার পথে ইঞ্জিনে আগুন লেগে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ নামের জাহাজটিতে।

শুক্রবারের ঘটনায় নৌ বাণিজ্য দপ্তর ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিন সদস্যের ওই কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এই কমিটির সদস্যরা হলেন— নৌ বাণিজ্য দপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন শেখ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন গাজী, প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার মো. রফিকুল আলম ও এমভি বে-ওয়ানের ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হোসেন। এই কমিটি পুরো জাহাজটি সার্ভে করবে।

ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব ক্লাসিফিকেশন সোসাইটিজের (আইএসিএস) নীতিমালা অনুযায়ী, যে কোনো জাহাজের গড় আয়ু নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ২৫ বছর। সেই হিসেবে চট্টগ্রাম-সেন্টমার্টিন নৌরুটে পর্যটক নিয়ে চলাচলকারী ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ আয়ুষ্কাল হারিয়েছে অন্তত চার বছর আগে। কিন্তু চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড সেই জাহাজটিকে নিয়ে এসে ঘষামাজা করে বানিয়েছে প্রমোদতরী।

জানা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই সাগরপথে যাতায়াত করছে বে-ওয়ান ক্রুজ। জাহাজটির মালিক কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ রশিদও শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বললেন, ‘নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়েই সেন্টমার্টিন রুটে চলছে বে-ওয়ান।’

জাহাজটির ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়েই চলাচল করছে। কিন্তু সামান্য ত্রুটি হয়েছে ইঞ্জিনে। সেটি ঠিকও হয়ে গিয়েছিল। এ জাহাজ সাগরে ভাসতে কোনো অসুবিধা নেই।’

জাহাজটি সমুদ্রে আরও ১০০ বছর চলতে পারবে— এমন দাবি করে এমএ রশিদ বলেন, ‘আমি প্রয়োজনে এই জাহাজ বন্ধ করে দেবো। জাহাজের পেছনে যা খরচ, তা পোষানো সম্ভব হচ্ছে না। সেন্টমার্টিন গিয়ে আবার চট্টগ্রামে আসতে ১১ হাজার টন জ্বালানি লাগে জাহাজটিতে। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরও খরচ যুক্ত হয়।’

জাপানের তৈরি সালভিয়া মারু জাহাজটিকে কেনার আগে সেটা মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল কিনা— এমন প্রশ্নে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের এই এমডি বলেন, ‘কে বলেছে আপনাদের পুরানো স্ক্র্যাপ জাহাজ কিনেছি। এটা কেনার পর আমরা শুধু রং করেছি। জাহাজটির সার্বিক কন্ডিশন ভালো ছিল। তাই আমি কেনার পর বিলাসবহুল ক্রুজটি এ রুটে দিয়েছি। দুর্ঘটনার আগের দিনও নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সেন্টমান্টিন থেকে এসেছে। কই তখন তো কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন ফরিদ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাহাজের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ডিজি শিপিং কর্তৃপক্ষ। আর চলাচলের জন্য অনুমোদন দেয় বিডব্লিউটিএ। তাদের ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকায় আমরা চলাচলের অনুমতি দিয়েছি। যেহেতু আমরা জাহাজের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নই। সুতরাং আমরা শুধু বন্দর চ্যানেল ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি।’

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বে ওয়ান ক্রুজটির মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হলো জাপানের মিটসুবিশি হেভি ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেড। ১৯৯২ সালের ২৫ ডিসেম্বর সালভিয়া মারু নামে জাহাজটি সমুদ্রে নামে। ওই সময় অনুযায়ী ইতোমধ্যে জাহাজটি ৩০ বছর অতিক্রম করেছে। অথচ ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব ক্লাসিফিকেশন সোসাইটিজের (আইএসিএস) নীতিমালা অনুযায়ী একটি জাহাজ তৈরির সময় থেকে পরবর্তী ২৫ বছর পর আর সেটার ফিটনেস থাকে না।

সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড এই জাহাজটি নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে যে আবেদনপত্র জমা দেয়, সেখানে আয়ুষ্কালের বিষয়টি এড়িয়ে যায়। শিপিং কর্পোরেশনের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে লিখিত কোনো মতামত না দিয়ে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডকে বে-ওয়ান ক্রুজ জাহাজটি চলাচলের অনুমোদন দেয়।

গত বছরের শুরুর দিকে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌ পথে চলাচলের অনুমোদন নিয়ে অবৈধভাবে পতেঙ্গা-সেন্টমার্টিন যাতায়াত করার অভিযোগে পারমিটের শর্তভঙ্গ করায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগ শোকজ করে এমভি বে-ওয়ান জাহাজটির পরিচালক প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী শিপ বির্ল্ডাসকে।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সাগরপথে চলাচলে জাহাজটি অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্ঘটনা আরও বড় হতে পারতো। সুতরাং ফিটনেসবিহীন এসব জাহাজ আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত।’

শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার পথে বে-ওয়ান ক্রুজ নামের জাহাজটিতে যখন আগুন ধরে যায়, তখন ওই জাহাজে অবস্থান করছিলেন চট্টগ্রামের মানবধিকার কর্মী আমিনুল হক বাবু। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বললেন, ‘বে-ওয়ান ক্রুজের ফিটনেস নেই। মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ হওয়ায় পথে দুর্ঘটনা ঘটছে। এটি কিভাবে অনুমোদন পেল তা খতিয়ে দেখা উচিত।’

বে-ওয়ান ক্রুজে চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিন যেতে এখন ভাড়া গুণতে হয় দুজনের ভিভিআইপি কেবিন ৬০ হাজার টাকা, দুজনের ভিআইপি কেবিন ৪০ হাজার টাকা, ইকোনমি চেয়ারপ্রতি ভাড়া সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকা।


আরো খবর: