ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি – রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ার ২৩ নম্বর বাড়ি। দুইদিন আগেও প্রাণবন্ত এই বাড়িতে ছিল হই-হুল্লোড়। অথচ আজ বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন, থেমে থেমেই কান্নার শব্দ; সবমিলিয়ে পরিবেশটা গুমোট। হাজারও স্বপ্ন নিয়ে পরিবারের ছোট ছেলে আরিয়ান আলমকে উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডায় পাঠিয়েছিলেন বাড়ির কর্তা এ টি এম আলমগীর। সেই ছেলেই এখন মাত্র ২১ বছর বয়সে ঢাকা থেকে ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে চিরঘুমে শুয়ে আছে। বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টার দিকে বাড়িটিতে দেখা গেল এমনই চিত্র।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কানাডার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে টরন্টোর ৪২৭-এর ‘ডানডাস ষ্ট্রিট’ ওয়েস্টে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার প্রায় ১০ ঘণ্টা পর খবর পায় আরিয়ানের পরিবার। এ দুর্ঘটনায় আরিয়ানের আরেক বন্ধু স্থানীয় একটি হাসপাতালে এখন লাইফ সাপোর্টে আছেন।
ছেলেকে হারিয়ে মা রেজিনা সুলতান পলি করেছিলেন আর্তনাদ। স্বজনরা পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা যে যার মতো স্বান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে মায়ের কান্না কিছুতেই থামছে না। সেদিক থেকে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে থেমে থেমে কথা বলছেন বাবা এ টি এম আলমগীর। ছেলেকে নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা তুলে ধরে জানালেন, ‘স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষা শেষ করে বাবার ব্যবসার হাল ধরবে আরিয়ান। বাড়িতো ফিরবে, তবে লাশ হয়ে।’
দেশে প্রথমে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ‘মাস্টার মাইন্ড’, পরে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনা করে আরিয়ান। ‘ও’ লেভেল শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর কানাডার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন আরিয়ান আলম। তার ইচ্ছে ছিল সিএ পড়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার। সেই উদ্দেশ্যে শুরুতে ‘ব্রেইমার কলেজ’ থেকে ডিপ্লোমা করে চলতি বছর ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে টরন্টোর হাম্বার কলেজে ভর্তি হন।
কথার ফাঁকে ফাঁকে ফোনও সামলাচ্ছেন, বিভিন্ন জন ফোন করে স্বান্ত্বনা দেওয়া চেষ্টা করছেন। এর ফাঁকেই এ টি এম আলমগীর জানালেন, দেশ থেকে যাওয়ার পর শুরুতে আরিয়ান টরন্টোর নর্থ ইয়র্কে বন্ধুদের সঙ্গে উঠেছিলেন। কিন্তু নতুন কলেজে ভর্তির পর কিছুদিন হলো বন্ধুদের ছেড়ে নতুন জায়গায় চলে আসেন। সেখানে সবে এক মাস ক্লাস করেছেন তিনি। এরই মধ্যে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ছিল আরিয়ানের জন্মদিন। বন্ধুরা নর্থ ইয়র্ক থেকে আরিয়ানের নতুন আবাসস্থল ইতোবিকো-তে এসেছিলেন জন্মদিন পালন করতে। জন্মদিনের দুই দিন পর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার স্বপ্ন সড়কেই শেষ হলো আরিয়ানের।
কিছুটা বলেই আবার টিস্যু দিয়ে চোখ মুছছিলেন এ টি এম আলমগীর। কাঁদতে কাঁদতে দুচোখ লাল হয়ে উঠেছে তার। সোফায় একটু হেলান দিয়ে আবার বলছিলেন, ‘গত ৪ ফেব্রুয়ারি নতুন বাসায় ওঠে সে। বাসার জন্য অনেক মালামালও কিনেছিল, তবে কিছুই এখনও সাজানো হয়নি। এরই মাঝে আমার ছেলেটা চলে গেল। আহারে, একি হলো! আমার ছেলেটা আর নেই!’ বলতে বলতেই হাহাকার করে উঠলেন এ টি এম আলমগীর।
চার ভাই বোনের মধ্যে আরিয়ান আলম ছিল সবার ছোট। পরিবার-বন্ধুদের কাছে আরিয়ান দীপ্ত নামেই পরিচিত। গত বছর দুই বার দেশেও এসেছিলেন তিনি। সবশেষ ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন; সেসব স্মৃতিচারণ করছিলেন নিহত আরিয়ানের বড় ভাই মো. সানবির আলম। তিনি আগতদের কাছে ছোটভাইয়ের নানান শখের জিনিস তুলে ধরছিলেন। খেলাধুলায় বেশ আগ্রহী ছিল আরিয়ান। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন বাসায় আরিয়ানের কক্ষটিও। সুন্দর পরিপাটি সাজানো ঘরটিতেও নেমে এসেছে শুনশান নীরবতা।
পাশেই বিলাপ করছিলেন আরিয়ানে চাচা এ এস এম হুমায়ুন। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলছিলেন, ‘এখন কে আমাকে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, চাচা কেমন আছো।’
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কানাডার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টায় আরিয়ান ও তার তিন বন্ধুর গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। কিন্তু তার পরিবার জানতে পারে বাংলাদেশ সময় ১৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার পর। আরিয়ানের বোন সানজিদা আলমকে তার (আরিয়ান) এক বন্ধু ফোনে দুর্ঘটনার কথা জানান। এর পর থেকে পরিবার যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এ টি এম আলমগীর জানান, দুর্ঘটনার পর সেন্ট মাইকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে ওদের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একবারই কথা হয়েছে তার, এরপর আর যোগাযোগ করতে পারেননি। আরিয়ানের বড় বোন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ভাইয়ের খবর শুনে তিনি কানাডায় গেছেন।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আইএ/ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩