ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক উদ্বেগের কারণ যদি হয় বিবিসির তথ্যচিত্র, তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বেগের কারণ মুসলমান ভোট। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস উঠেপড়ে লেগেছে প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায়ের দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টকে (আইএসএফ) নিয়ন্ত্রণ করতে। আইএসএফের শীর্ষ নেতৃত্বকে সম্প্রতি গ্রেপ্তারের পাশাপাশি লাগাতার মারধর করা হচ্ছে। তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক কার্যকলাপে লাগাম দেন। আইএসএফ গত বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪টির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ১টি আসন পেয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২১৫টি আসন। এত ক্ষুদ্র একটি দলকে এত ভয় দেখানোর কী প্রয়োজন, তা একটা প্রশ্ন।
এ প্রশ্নের উত্তরও হয়তো সেই একই, যা নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে যেমন একটি সামান্য তথ্যচিত্র আটকাতে সব শক্তি প্রয়োগ করেছে মোদি সরকার, তেমনই দীর্ঘ ১২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর একটি ক্ষুদ্র দলকে রুখতে উঠেপড়ে লেগেছেন মমতা। মোদির মতোই মমতার ভয় একটাই—‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’ বা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার হাওয়া। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কেন্দ্রে রয়েছে মুসলমান সমাজ, তাদের ভোট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের চিরকাল প্রধান ভরসা। এই ভোট একসময় কংগ্রেস পেয়েছে, পরবর্তীকালে পেয়েছে বামফ্রন্ট এবং এখন পাচ্ছে তৃণমূল। এখন মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ, বিশেষত শিক্ষিত অংশ, বলতে শুরু করেছে, প্রধানত তাদের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলেও তাদের জন্য বিশেষ কিছুই করেননি মমতা।
এ কথা সংখ্যালঘুরা ১২ বছর আগে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে বলতেন। এই কারণেই তাঁরা মোটামুটি জোটবদ্ধভাবে ২০১১ সালে মমতাকে ভোট দিয়েছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের পতন হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মুসলমান, প্রতি তিনটিতে একটি ভোট তাদের। স্বাভাবিকভাবেই সরকার গড়তে যেকোনো দলের এই ভোটের বড় অংশ পাওয়া জরুরি। অতীতে ভোটের বড় অংশ পেয়েছে বামফ্রন্ট, তার আগে কংগ্রেস। বর্তমানে পাচ্ছে তৃণমূল। যদিও মমতার জন্য যা বিশেষ উদ্বেগের, তা হলো মুসলমান সমাজ যদি তাদের মধ্যে থেকে উঠে আসা একটি দলকে ভোট দেয়, তবে তৃণমূলের কী হবে?
এককথায় বললে, হেরে যাবে। এর কারণ, ধারাবাহিকভাবে দেখা যাচ্ছে, হিন্দু সমাজের বড় অংশ ধীরে ধীরে বিজেপির দিকে চলে যাচ্ছে। আর যত তারা বিজেপির দিকে যাচ্ছে, ততই মুসলমান সমাজ আরও বেশি করে ভোট দিচ্ছে তৃণমূলকে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দু সমাজের মোটামুটিভাবে ৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল বিজেপিকে, কিন্তু মুসলমান সমাজের ৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল তৃণমূলে। এ তথ্য দিল্লির গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিস’-এর নির্বাচন সমীক্ষা প্রকল্প ‘লোকনীতি’র। আর হিন্দু সমাজের ভোট যখন বিজেপি ছাড়াও অন্যান্য দল, যেমন বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসে যাচ্ছে, তখন মুসলমান ভোট কিন্তু জোটবদ্ধ হয়ে পড়ছে তৃণমূলের বাক্সে।
অর্থাৎ, প্রধানত মুসলমান ভোটেই তৃণমূল যে ক্ষমতায় রয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু মমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি জানেন, মুসলমান সমাজের জন্য বিরাট কাজ করলে হিন্দু ভোট আরও জোটবদ্ধ হয়ে বিজেপির দিকে যাবে। গত কয়েকটি নির্বাচনে তা-ই হয়েছে। কিন্তু যতটা হিন্দু ভোট পেলে বিজেপি জিততে পারত, তা তারা পায়নি। কিন্তু মমতা যদি এখন মুসলমান সমাজের অধিকাংশ দাবিদাওয়া মেনে নেন, তাহলে ভবিষ্যতে হিন্দু ভোট আরও একত্র হবে। তৃণমূলের বিপদ বাড়বে। এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও মমতা মুসলমান সমাজের জন্য সরাসরি বিরাট কিছু করতে পারবেন না।
কিন্তু মমতা মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য যথেষ্ট করছেন না—এটাই আইএসএফের পশ্চিমবঙ্গে উত্থানের একমাত্র কারণ নয়। ভারতে হিন্দু দলের বাড়বাড়ন্ত হলে মুসলমানকেন্দ্রিক দলের জনপ্রিয়তা বাড়ে। যেমন হায়দরাবাদের পুরোনো দল অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়ছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে। আবার উল্টোটাও সত্যি। অর্থাৎ, মুসলমান সংগঠন শক্তিশালী হলে হিন্দুরা জোটবদ্ধ হন। যেমন ১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের জন্ম হওয়ার ৯ বছর পরে দিল্লিতে তৈরি হয় হিন্দু মহাসভা। এটাই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান রাজনীতির ইতিহাস।
পশ্চিমবঙ্গ এই ইতিহাসের কেন্দ্রে থেকেছে। ইতিহাসের কৃতী ছাত্রী না হয়েও মমতা জানেন, হিন্দুত্ববাদী দলের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানপ্রধান দলের শক্তিও বাড়বে। এটা হলেই পশ্চিমবঙ্গে পরাজিত হবে তৃণমূল, যেমনটা পূর্ব ভারতের আসামে ২০১৬ সালে হয়েছে কংগ্রেস। ২০০৫ সালে আসামে গঠিত হয়েছিল আইএসএফের মতোই বাঙালি মুসলমানপ্রধান দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)। তারপর আসামে বাঙালি মুসলমানের ভোট কংগ্রেস থেকে ধীরে ধীরে এআইইউডিএফের দিকে সরতে শুরু করে।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাঙালি মুসলমানের ১৩ শতাংশ ভোট টেনে নিয়ে কংগ্রেসকে হারিয়ে দেয় এআইইউডিএফ। বিজেপি জেতে এমন এক রাজ্যে, যেখানে মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ (২০১১)। বাঙালি মুসলমানের ভোট ভাগ না হলে সেখানে বিজেপির পক্ষে জেতা সম্ভব ছিল না। এ কারণে কংগ্রেস বারবার অভিযোগ করেছে যে এআইইউডিএফকে সাহায্য করছে বিজেপি। একই অভিযোগ রয়েছে হায়দরাবাদের এআইএমআইএম এবং এখন পশ্চিমবঙ্গের আইএসএফের বিরুদ্ধে।
তৃণমূলের জানে বাঙালি মুসলমানের ভোটের সামান্য অংশও যদি আইএসএফে চলে যায়, তবে হার অবশ্যম্ভাবী। এটা বুঝেই আইএসএফের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপরে তৃণমূল পরিচালিত পুলিশের লাঠি চালনা ও গ্রেপ্তারের কড়া নিন্দা করেছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চা। বিজেপিও জানে, মুসলমানপ্রধান দলের উত্থানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী দলের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ।
তবে এখন পর্যন্ত মুসলমান সমাজের বড় অংশ একমত যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানো চলবে না। ফলে টানা পাঁচ বছর ধরে মুসলমান সমাজ তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধাচরণ করলেও বিধানসভা নির্বাচনে এখনো জোটবদ্ধ হয়ে তৃণমূলকেই ভোট দিচ্ছে।
মুসলমান সমাজের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষায় যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ, পশ্চিমবঙ্গে ‘মিশন মুভমেন্ট’ বা বিভিন্ন দাতার টাকায় চলা বেসরকারি শিক্ষা আন্দোলন। মিশন পরিচালনাকারীদের বক্তব্য, গরিব পরিবারের সন্তানদের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে হচ্ছে, তা অন্য রাজ্যে হচ্ছে না। গ্রামের হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনেকে এখন মুসলমান সমাজ থেকে আসছেন।
অনেকেই স্কলারশিপ পেয়ে ইউরোপ-আমেরিকার নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছেন। এটাকে বড় পরিবর্তন বলে মনে করছে মুসলমান সমাজ। এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করতে তৃণমূল সরকার বিরাট ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে এমন নয়, কিন্তু আবার সংখ্যালঘু শিক্ষা আন্দোলন বন্ধ করারও চেষ্টা করেনি। মুসলমান সমাজের ভয়, বিজেপি ক্ষমতায় এলে জাকাত ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলা শিক্ষা আন্দোলনের ওপর নজরদারি শুরু হবে, যেমন বিজেপি-শাসিত আসামে হয়েছে। সেখানে সরকারি মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং বেসরকারি মাদ্রাসার ওপরে শুরু হয়েছে প্রবল নজরদারি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার লাগাতার হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজায় টাকা দিচ্ছেন এবং ঢালাও মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে মুসলমান সমাজের ওপরে বিরাট চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে, যেমনটা হয়েছে আসাম, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ বা জম্মু-কাশ্মীরে
এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজের ব্যবসা-বাণিজ্যে হাত দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস; বরং যেসব অঞ্চলে মুসলমানরা বসবাস করেন, সেসব অঞ্চলের বাইরেও ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিশেষত নির্মাণশিল্পে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছেন সংখ্যালঘুরা। বড় ধরনের কোনো দাঙ্গা হয়নি এবং মুসলমান সমাজকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমনও নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার লাগাতার হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজায় টাকা দিচ্ছেন এবং ঢালাও মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে মুসলমান সমাজের ওপরে বিরাট চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে, যেমনটা হয়েছে আসাম, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ বা জম্মু-কাশ্মীরে।
এ কারণে মুসলমান ভোট নিয়ে এই মুহূর্তে বিরাট নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার প্রয়োজন তৃণমূল কংগ্রেসের নেই। কিন্তু সমাজ, সময় ও রাজনীতি পরিবর্তনশীল। ফলে, আগামী দিনে বিজেপির হিন্দু ভোট যত এক জায়গায় আসবে, ততই আইএসএফের মতো সংখ্যালঘু দলের জনপ্রিয়তা বাড়বে। যেহেতু বিজেপি শক্তিশালী, তাই এই স্বাভাবিক প্রবণতা রুখতে তাদের মারতে শুরু করেছে তৃণমূলের পুলিশ, মার খাচ্ছেন আইএসএফের নেতা-কর্মীরা। আগামী বেশ কয়েক বছর যে তাঁদের মার খেতে হবে, তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই।
সূত্র: প্রথম আলো