মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসা যে অপরাধ তা জেনেও আমরা করে যাচ্ছি, এ ক্ষেত্রে আমাদের পরিবার থেকে শিক্ষা নিতে হবে। নিরস্ত্র জনতাকে ৭ই মার্চের ভাসনের মাধ্যমে উজ্জীবিত করে সশস্ত্র জনতাকে যে হারিয়ে দিবে তা কেউ ভাবতে পারেনি, কিন্তু আমরা সফল হয়েছি। ঠিক এভাবে মাদকসহ প্রত্যেক চ্যালেঞ্জিং বিষয় নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে তাহলে আমরা সফল হবো। বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনের শুরুর দিকে নারী ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছেন এবং ঘোষণা দিয়ে মদ- জুয়া নিষিদ্ধ করেছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, একজন নাগরিকের দায়িত্ব কি হবে তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছেন।
২০ই ডিসেম্বর সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা- স্কাসের আয়োজনে মাদক ও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে একটি আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মোঃ শামসুল হক টুকু এই কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসার সাথে কেউ জড়িত হবে না, তা শপথ নিতে হবে। সন্তানদের মাদকাক্ত হওয়ার পূর্বেই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উচিত সবাই যেন নেতা-নেত্রী তৈরিতে মাদকের বিষয়ে সচেতন হয়। মাদকাসক্ত স্বামীর হাতে নারী সহিংসতা বেশি হচ্ছে, সুতরাং মাদকাসক্তি হলো নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম কারণ। মাদক নিরাময় করার আগে মাদক প্রতিরোধ করার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সুষ্ঠ সমাজ পরিচালনার জন্য ডোপটেস্টের ব্যবস্থা করা,পারিবারিক সচেতনতা তৈরি করা ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা সহ মাদক নির্মূলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
শামসুল হক টুকু বলেন, রোহিঙ্গাদের আগমন মরার উপর ক্ষরার ঘা হলেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে মানবিকতার শিক্ষা দিয়েছে বাংলাদেশ।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি বলেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তি শুধু নিজেকে ধ্বংস করে না, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে। মাদকাসক্তের পাশাপাশি স্কিন আসক্তি আরো বেশি ক্ষতি করছে, এ নিয়ে পার্লামেন্টে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে হবে। মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মা’দেরকে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। দারিদ্রতা হলো নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম কারণ। অভাব থেকে নারীর প্রতি সহিংসতার শুরু। দরিদ্র বিমোচন নারী এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম সহায়ক।
আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে আসিফ শামস্ রঞ্জন, মেয়র-বেড়া পৌরসভা-পাবনা বলেন, নারীদের প্রতি সহিংসতা মূলত আসে দুর্বলতা থেকে তাই নারীদের ক্ষমতায়ন করতে হবে এবং দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর করতে হবে। নারীদের শোষণের ইতিহাস আদিকাল থেকে, তবে এটি ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে স্কাস।
আলোচনায় দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য মাদক দায়ী উল্লেখ করে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমরান হোসেন সজীব বলেন, একটি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য যে সমস্ত ফ্যাক্টর কাজ করে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাদক। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদন অঞ্চল নয়, তবে বাংলাদেশের তিন পাশে মাদক উৎপাদনের দেশ, তাই আমরা মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছি। এটা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমত, মাদক নিয়ন্ত্রণের ট্রানজিট পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং উপজেলা ভিত্তিক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। মাদক কারবারিরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে সেক্ষেত্রে মাদক নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তিগত যাবতীয় ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সচেতনামূলক কার্যক্রম গুলো প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে আসতে হবে।
সভায় উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, সমাজের একটা অংশ মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। যে পরিবারের সদস্যারা মাদকাসক্ত তাদের দোযখ দেখার জন্য পরকালের অপেক্ষা করতে হয় না, তারা পুরো পরিবার খুব ইহকালেই দোযখের অশান্তি ভোগ করে। বঞ্চিত নারীদের এগিয়ে নেওয়া ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার জন্য স্কাস গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। এক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থা গুলোকেও স্কাসের মত সমাজ উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে।
জেলা পরিষদের সদস্য আশরাফ জাহান কাজল তার আলোচনায় বলেন, নারীদের নিজ পায়ে দাঁড়াতে হবে, নারীর নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, নারীদের মানসিকভাবে আরো শক্তিশালী হতে হবে এবং মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে, বাস্তবমুখী হয়ে কাজ করতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সমাজে শান্তি শৃংখলা বজায় থাকবে।
বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত বন্ধ বা সীল করার দাবী জানিয়ে কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সম্পাদক মুজিবুল ইসলাম বক্তব্যে বলেন, মাদক বাংলাদেশের জন্য সংকট এর বিষয় কারণ মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট হল কক্সবাজার। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সীমান্ত অরিক্ষিত, সেটা সুরক্ষিত করতে হবে, তাহলে মাদকের আগ্রাসন কমে যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে পদ্মাসেতুর মত বড় প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেছেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মায়ানমারে যদি সীমান্ত বন্ধ করে বা সীল করে দিলে মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করা সম্ভব। তরুণ যুব সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে গেছে, অনেকই মাদক ব্যবস্যায় জড়িত হয়েছে, মাদক সেবীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের মোট জনসংখ্যার ৫১% নারী তবুও নারীরা পিছিয়ে, তাই নারীদের কে ক্ষামতায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। নারীদের সুযোগ দিলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। নারী প্রধান এনজিও স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমার নারীদের ক্ষমতায়ন সহ দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ সত্যি প্রশংসনীয়।
উখিয়া প্রেস ক্লাব সভাপতি সাঈদ মোহাম্মদ আনোয়ার উখিয়ার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে বলেন, মাদক ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য বেকারত্ব দূর করা একটি অন্যতম মাধ্যম। উখিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তাই শিক্ষার স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে উখিয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার দাবী জানাচ্ছি। সরকার কর্তৃক মাদক নিয়ে তৈরীকৃত তালিকা কার্যকর করার জন্য অনুরোধ করছেন।
সিসিএনএফ সেক্রেটারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য ফান্ড কমে যাওয়া, ফান্ড আনয়নের অনুমোদন বিলম্ব হওয়াতে উখিয়া উপজেলায় কর্মরত এনজিও গুলো সেবা প্রদানে বিভিন্ন চ্যালঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এনজিও ব্যুরো যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে এফডি-৭ ও এফডি-৬ এর অনুমোদনের কাজটি সম্পাদন করেন তাহলে সকল এনজিও পরিকল্পনা অনুসারে কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হবেন। এছাড়াও তিনি মাদক নিরোধ করার জন্য মহাপরিকল্পনা করার জন্য অনুরোধ করেন।
উক্ত আলোচনা সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান কালে সমাজ কল্যাণ উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান জনাব জেসমিন প্রেমা বলেন, স্কাস ১৯৯৫ সাল থেকে মাদক ও নারী সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছেন এবং বর্তমানে কর্মী নিয়োগে ডোপটেস্টের ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন। কাজের সুযোগ পেলে নারীরা অনেকদূর এগিয়ে যাবে। দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া জন্য দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই, পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা সমান ভাবে এগিয়ে গেলে উন্নত দেশের কাতারে পৌছে যাবে সোনার বাংলাদেশ। তাই নারীদের কাজের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছেন স্কাস। বক্তব্যে প্রধান অতিথিসহ উপস্থিত সকলকে স্কাসের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছেন।
আলোচনা সভা শেষে প্রধান অতিথি জনাব মোঃ শামসুল হক টুকু এমপি, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার স্কাসের জেপি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার উদ্বোধন করেন এবং অন্যান্য অতিথিবৃন্দ সহ ট্রেনিং সেন্টারের বিভিন্ন ট্রেডের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন।