ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে নতুন মাদক ক্রিস্টাল মেথ-আইসের আগ্রাসন। বিভিন্ন বয়সী মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ছে দানাদার নতুন এ মাদকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অন্ধকারে রেখে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ ২৮ রুট দিয়ে ছয় ধরনের ক্রিস্টাল মেথ দেশে ঢুকে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন প্রান্তে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে আইস রীতিমতো একটি আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ইয়াবা মাফিয়ারাই নিয়ন্ত্রণ করছে ভয়ংকর মাদক আইসের অন্ধকার জগৎ। আইসের অন্যতম ডিপো হয়ে ওঠা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প থেকেই তা নানা কৌশলে পাচার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে রোহিঙ্গা ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার হতদরিদ্রদের। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেফতার হওয়াদের কাছ থেকে এরই মধ্যে কয়েকজন ক্রিস্টাল মেথ মাফিয়ার নাম জানতে পেরেছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
উঠে এসেছে নানা তথ্য।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘যারা ইয়াবা পাচার করে তাদের একটি অংশ এখন ক্রিস্টাল মেথ পাচার করছে। মাদক চক্রের হোতারা আড়ালে থেকে ক্যারিয়ারদের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ক্রিস্টাল মেথ পাচার করছে। এরই মধ্যে তদন্তে কিছু ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে।
তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থলপথ ছাড়া সাগরপথেও অভিন্ন কায়দায় পাচার হচ্ছে এ মাদক। ক্রিস্টাল মেথ পাচারের কৌশল নজরে আসার পর পাচার রোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সাগরপথে ক্রিস্টাল মেথ পাচারের মাদক মাফিয়ারা শক্তিশালী বিভিন্ন রঙের লেজার লাইট ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে তারা নানা রঙের লেজার লাইট ব্যবহার করে একে অন্যকে বার্তা দেয়।
ওই সংকেতের ওপর ভিত্তি করে ক্রিস্টাল মেথের চালান হস্তান্তর হয়। এ ছাড়া মিয়ানমার পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনের (এমপিটি) সিম দিয়ে মাদক কারবারিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। এমপিটির রোমিংয়ে বিশেষ সুবিধা থাকায় এ সুবিধা গ্রহণ করে মাদক কারবারিরা। ক্রিস্টাল মেথের স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা বেশি হওয়ায় এবং ইয়াবার তুলনায় বহন করা সহজ হওয়ায় ইয়াবা কারবারিরা এখন ক্রিস্টাল মেথ পাচারের দিকে ঝুঁকছে। তারা নানা কৌশলে ক্রিস্টাল মেথ পাচার করছে। ক্রিস্টাল মেথ পাচারের কিছু পদ্ধতি আমাদের নজরে এসেছে। তাই এ কৌশলগুলো নিয়ে সতর্ক থাকতে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্যমতে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগে আইসের বিরুদ্ধে ২৮টি সফল অভিযান পরিচালিত হয়। এসব অভিযানে ৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার প্রায় সবাই আইসের ক্যারিয়ার ছিল। এ পর্যন্ত আইসসহ গ্রেফতার ব্যক্তির প্রায় সবাই ক্যারিয়ার। জিজ্ঞাসাবাদে নেপথ্য হোতাদের নাম জানাতে পারেনি তারা। তবে যারা ইয়াবা সম্প্রসারণ করেছে তারাই এখন বাংলাদেশে আইস পাচার করছে। জানা যায়, মাদকের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল খ্যাত মিয়ানমারের শান স্টেট থেকে বাংলাদেশে আসছে নতুন মাদক আইস। শান স্টেটে ক্রিস্টাল মেথ তৈরি হলেও এর কাঁচামাল আসে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস ও চীন থেকে। মিয়ানমারভিত্তিক মাদক মাফিয়ারা কাঁচামাল নিয়ে আসে শান স্টেটে। এরপর মিয়ানমারভিত্তিক মাদক মাফিয়াদের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় আইস। ওই মাদক কারখানাগুলোয় ছয় ধরনের আইস তৈরি হয়, যার মধ্যে রয়েছে স্বচ্ছ কাচের মতো, মিছরির মতো ধলাকৃতি, স্ফটিক স্বচ্ছ পাথরাকৃতি সাদা, নীলাভ, সামুদ্রিক দানাদার লবণ ও শক্ত বরফের আইস। শান স্টেটে তৈরি মাদক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, মিয়ানমারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের সহায়তায় নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায়। সেখান থেকে ২৮টি রুটে প্রবেশ করানো হয় বাংলাদেশে। এ রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে- টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, হ্নীলা, হোয়াক্যং, উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, রাজাপালং, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, সেন্ট মার্টিন হয়ে চট্টগ্রামের মহেশখালী, কর্ণফুলী চ্যানেলে আনোয়ারা, গহিরা, বাঁশখালী, জলদ্বীপ, পারকির চর, পতেঙ্গা, সীতাকুন্ড ও মিরসরাই। একই রুটে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এসে মেঘনা পাড়ি দিয়ে যায় বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া, লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর ঘাট, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, ষাটনল ও নারায়ণগঞ্জে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আইস বিস্তারে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা ও বর্ডার গার্ড ফোর্স বাহিনী জড়িত। মিয়ানমার ও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। মাদক মাফিয়ারা আর্থিক লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং টেকনাফ-উখিয়ার দরিদ্র লোকজনকে মাদক সরবরাহ ও পাচারের কাজে ব্যবহার করছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মাদকসংশ্লিষ্টরা অর্থলগ্নি করে। টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ক্রিস্টাল মেথ মজুদ করা হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, মিয়ানমারের শান স্টেটে প্রতি কেজি আইস বিক্রি হয় আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকায়। টেকনাফ সীমান্তে তা ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্রিস্টাল মেথের চাহিদা তৈরি করতে ডাম্পিং দামে (প্রকৃত দায়ের চেয়ে কম) বিক্রি করা হয় ক্রিস্টাল মেথ। মিয়ানমার থেকে বড় চালান এলেও কক্সবাজার থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করতে চালানগুলো ছোট করে ফেলা হয়। কখনো কখনো পিস আকারে পাচার হয় ক্রিস্টাল মেথ। অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদকের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল খ্যাত মিয়ানমারে শান স্টেট থেকেই বাংলাদেশে আসে আইস। মিয়ানমার ও বাংলাদেশভিত্তিক কয়েকটি মাদক চক্রের সহায়তায় আইসের চালান চলে যায় কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে। ওই ক্যাম্পগুলো থেকে পরবর্তীতে ক্রিস্টাল মেথ পাচার হয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে জরুরি পণ্য পরিবহনের ট্রাক, লাশবাহী গাড়ি, তেলের লরি, অ্যাম্বুলেন্সে পাচার করা হয় আইস। এ ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পারসেলে, মালামাল পরিবহনের ট্রান্সপোর্টে ও দূরপাল্লার পরিবহনে কক্সবাজার থেকে পাচার হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথের চালান। স্থলপথ ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের জেলেদের সহায়তায় চট্টগ্রাম, বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ হয়ে মাছ ধরার ট্রলারে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার হচ্ছে আইস। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক গোপন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছর ধরে গাণিতিক হারে বাড়ছে ক্রিস্টাল মেথের চাহিদা। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন এ মাদকের পাচারও বেড়েছে। গত এক বছরে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ক্রিস্টাল মেথের ছোট-বড় ২৮টি চালান জব্দ করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। চাহিদা বাড়ায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন জায়গায় মজুদ হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ। এ ছাড়া সাগরপথে ইয়াবার সঙ্গে আনা হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথের চালানও। গভীর সমুদ্রে ক্রিস্টাল মেথের চালান হাতবদল হয়ে পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন