এম জিয়াবুল হক, চকরিয়া::
সাতদিনের টানা ভারী বৃষ্টিপাতে মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি নাজুক অবস্থা তৈরি হয়েছে। অতিরিক্ত বর্ষণের কারণে বসতঘরের মাটির দেয়াল চাপা পড়ে পাশের লামা উপজেলার ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা রোজিনা আক্তার (৪৮) নামের এক গৃহবধূ নিহত হয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ভারী বর্ষণের ফলে বসতঘরের মাটির দেওয়াল ধ্বসে পড়ে ঘুমন্ত অবস্থায় রোজিনা আক্তার নামের এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। নিহত রোজিনা আক্তার চকরিয়া উপজেলার ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর উত্তর ঘুনিয়া এলাকার আবুল হোসেনের স্ত্রী। তারা বর্তমানে পাশের ইউনিয়ন লামার ফাসিয়াখালীতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
অপরদিকে গতকাল সকালে বাড়ির সামনে থেকে বানের পানিতে ভেসে গেছে ১২ বছর বয়সের কিশোরী। গতকাল দুপুরে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবী হোছাইন চৌধুরী। নিহত কিশোরী সাহারবিল ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড কোরালখালি গ্রামে মোহাম্মদ সেলিম প্রকাশ সেলিম খলিফার মেয়ে। একই পরিবারের আরো একটি মেয়ে এখনো নিখোঁজ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাহাড়ি ঢলের তাণ্ডবে মাতামুহুরী নদীর কোনাখালী, বিএমচর ইউনিয়ন ও চকরিয়া পৌরসভার দিগরপানখালী মজিদিয়া মাদরাসা এলাকায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ঢলের পানি। এই অবস্থার কারণে চকরিয়া উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকার দুইশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। তাতে সোমবার দুপুর থেকে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ফজলুল করিম সাঈদি বলেন, অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বেশিরভাগ এলাকার বসতঘর, টিউবওয়েল, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হাঁটু থেকে কোমড় সমান পানি ঢুকে পড়েছে। এ অবস্থার কারণে দুর্গত জনপদে মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানীয়জল ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আভ্যন্তরিন সড়কগুলো কয়েকফুট পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা একবারে অচল হয়ে পড়েছে।
সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়নে সোমবার থেকে কমপক্ষে ১৫টি গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বসতঘর পানিতে ডুবে গেছে।
হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেরজ
উদ্দিন মিরাজ, কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন, ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন বলেন, এবারের পাহাড়ি ঢলের বন্যা চকরিয়ার অতীতের ইতিহাসে রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে ইউনিয়নের প্রভৃতি জনপদ একাকার হয়ে গেছে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছালেকুজ্জামান বলেন, পুরো বরইতলী ইউনিয়নে বানবাসি মানুষের দুর্ভোগ যেন ধয্যের সীমা অতিক্রম করেছে। এমন কোন পরিবার নেই, বরইতলীতে বানের পানি ঢুকেনি। প্রায় প্রতিটি পরিবার গত দুইদিন ধরে নিদারুণ কষ্টে আছে। বাড়িতে রান্নার ব্যবস্থা নেই। টিউবওয়েল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানীয়জলের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, সড়কগুলো কয়েকফুট পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকার মানুষ জরুরি প্রয়োজনে কলা গাছের বেলা বানিয়ে চলাচল করছে।
কোনাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার ও বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সোমবার পাহাড়ি ঢলের পানির তাণ্ডবে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ এখনো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের ওই অংশ দিয়ে বানের পানি লোকালয়ে রীতিমতো জোয়ারভাটা সৃষ্টি করেছে।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানির প্রবল ধাক্কায় সোমবার রাতে চকরিয়া শহররক্ষা বাঁধের কয়েকটি অংশ ভেঙে গিয়ে মাতামুহুরী নদীর পানি ধেয়ে আসে চকরিয়া পৌরশহরের বাণিজ্যিক জনপদে। কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর দিয়ে প্রবাহিত ঢলের পানি চকরিয়া শহরের বেশিরভাগ মার্কেটে ঢুকে পড়ে। এতে কয়েকশ দোকানদার মালামাল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে শতকোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়েছে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া উপজেলা কর্মকর্তা মো.জামাল মোর্শেদ বলেন, মাতামুহুরী নদীতে এখনো পাহাড়ি ঢলের পানি নামছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালেও নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছিল।
তিনি বলেন, নদীতে ঢলের পানির গতিবেগ এখনো কমেনি। বৃষ্টিপাত কমে গেলে আমরা ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কারে কাজ শুরু করবো।
তবে ভাঙনের আশঙ্কা থাকায় চকরিয়া পৌরসভার দিগরপানখালী পয়েন্টে সোমবার রাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব জাফর আলম এর সহযোগিতায় বালুর বস্তা ফেলে এলাকাটি রক্ষায় কাজ করা হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি এখনো নাজুক অবস্থা রয়েছে। মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা বানের পানি যাতে সহজে নেমে যেতে পারে সেইজন্য উপকুলের স্লুইসগেট গুলো খুলে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসনের কন্ট্রোলরুম থেকে বন্যাদুর্গত এলাকায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে সার্বক্ষনিক মনিটরিং করা হচ্ছে। সাইক্লোন সেন্টার গুলোতে আশ্রয় নেওয়া বানবাসি মানুষের মাঝে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষথেকে বিশুদ্ধ পানীয়জল ও শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। ##