কক্সবাজার জেলা জুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটন নগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ৭টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এর পাশাপাশি শহরজুড়ে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ব, ছিনতাই ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ এখন প্রতিনিয়তই অজানা আতঙ্কে ভুগছেন।
অপরদিকে হঠাৎ করে তৎপরতা বেড়ে গেছে মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ব। সীমান্ত এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা আবারও গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ফলে নানা কৌশলে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা ও আইসের মতো মাদকের বড় বড় চালান। বিজিবি,র্যাব ও পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে মাদকের ‘ক্যারিয়ার’রা ধরা পড়লেও মূলহোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া জেলার ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার,খুন, গোলাগুলি এবং অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেই চলেছে।
জানা যায়, সম্প্রতিকালে কক্সবাজার শহরসহ জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। শুধু গত ১৫ দিনে জেলায় ৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩ এপ্রিল বুধবার দুপুরে উখিয়া উপজেলায় কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাওনা টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে জাহিদুল ইসলাম (২৩) নামে রোহিঙ্গা তরুণ নিহত হয়েছেন। একই দিন কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুলে জমিজমার বিরোধের জের ধরে ভাতিজার দায়ের কোপে চাচার দুই হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বুধবার ইফতারের পর খুরুশকুলের হাটখোলা পাড়ায় এঘটনা ঘটেছে।
গত ১২ এপ্রিল মঙ্গলবার জেলা শহরের বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় সংবদ্ধ ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন ব্যবসায়ী আবুল কালাম (৪৫)।
১১ এপ্রিল ভোরে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার পথে নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদের খোদাইবাড়ি এলাকায় ছুরিকাঘাতে নিহত হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তারেকুল ইসলাম।
২ দিন নিখোঁজ থাকার পর ১১ এপ্রিল সকালে কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডী সেতু এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় মোহাম্মদ সায়েম (২২) নামে এক যুবকের মরদেহ।
৮ এপ্রিল সকালে চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ে সংঘবদ্ধ জুয়াড়িরা পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় যুবক মোহাম্মদ ইউনুসকে।
সে রাতেই জেলা শহরের ঝাউতলা গাড়ির মাঠ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম রিগ্যান।
তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা সংকটাপন্ন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
৭ এপ্রিল বিকেলে পিএমখালী ইউনিয়নের চেরাংঘর বাজারে ইফতারের আগে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় প্রবাস ফেরত কৃষি উদ্যোক্তা মোরশেদ আলীকে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
৪ এপ্রিল ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় কক্সবাজার সদরের পিএমখালী গ্রামের যুবক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে (২৮)।
নিখোঁজের ৩ দিন পর গত ৬ এপ্রিল চকরিয়ার মাতামুহুরি নদী থেকে উদ্ধার করা হয় ইজিবাইক চালক সুমন কর্মকারের (২৬) মরদেহ।
গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় জেলা শহরের সিটি কলেজ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হন চট্টগ্রাম হাজী মুহসিন কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিদুয়ান (১৯)।
৩০ মার্চ ঈদগাঁয়ের একটি ইটভাটা থেকে উদ্ধার করা হয় সোহেল নামে ৭ বছরের এক শিশুর মরদেহ।
এদিকে গত ৭ এপ্রিল উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পূর্ব ফারিরবিল গ্রামে মাদক চোরাকারবারিদের উস্কানিতে গ্রামের অর্ধশত নারী সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালায় বিজিবি সদস্যদের উপর।
এতে ৩ বিজিবি সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হন। বিজিবির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় ৮০ হাজার ইয়াবাসহ আটক এক মাদক কারবারিকে।
৮ এপ্রিল টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ২ গ্রামের বাসিন্দারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে ২ পুলিশ সদস্যসহ ২০ জন আহত হয়।
এ ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় টেকনাফ মডেল থানায়।
এসব ঘটনা ছাড়াও পুরো জেলায় জমি দখল, চিংড়ি ঘের দখল, ছিনতাই, মারামারি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ নিয়মিত সংঘটিত হচ্ছে।
কক্সবাজার সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক এম এ বারী বলেন, ‘মূলত বেকারত্ব ও কর্মহীনতার কারণে কিশোর ও তরুণরা অপরাধে জড়াচ্ছে। কক্সবাজার শহরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা ইদানিং খুব বেশি বেড়ে গেছে।’
অপরাধ দমনে পুলিশ-র্যাব-আনসার-বিজিবিসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর নিয়মিত অভিযান দরকার বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘কিশোররা অপরাধে জড়াচ্ছে। তাই এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’