এএইচ সেলিম উল্লাহ::
কক্সবাজারে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ স্থাপনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে দেওয়া ৭০০ একর বনভূমির বরাদ্দ বাতিল করেছে সরকার। ইতিমধ্যে বাতিলকৃত জমিতে বসবাসরত ৮৬৫ দখলদারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।
দখলবাজদের তালিকার পাশাপাশি ওই জমিতে নানাবিধ উদ্যোগের প্রস্তাবনা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছে বনবিভাগ। এমনকি ওই প্রস্তাবনায় দখলকারীদের উচ্ছেদের আগেই নিদিষ্ট স্থানে পুনর্বাসন করা প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। এছাড়া ওই জমি চারপাশে নতুন করে যাতে দখল না হয়, সেজন্য ৪ হাজার মিটার কাঁটা তারের বেড়া দেয়ারও প্রস্তাব করা হয়।
বুধবার কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. নূরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বনবিভাগের পক্ষ থেকে প্রস্তুতকৃত তালিকা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। উচ্ছেদের ক্ষেত্রে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, কক্সবাজারের ‘রক্ষিত বনের’ জমিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপনের সিদ্ধান্তের আলোকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নামের একাডেমি গড়ে তুলতে ২০২১ সালে ৭০০ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ওই এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন। বরাদ্দ বাতিলের ব্যাপারে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফকে চিঠি দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে ওই বরাদ্দ বাতিলের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে একটি কমিটি করা হয়। তার আলোকে গত বছরের ১১ নভেম্বর বন্দোবস্ত বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উল্লিখিত বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানানো হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ বরাদ্দ বাতিল করা হয়।
গত ২৯ আগস্ট এ বিষয়ে আধা সরকারি পত্র দেন পরিবেশ উপদেষ্টা। ওই পত্রে বলা হয়েছে, বন্দোবস্তকৃত এলাকা ১৯৩৫ সাল থেকে ‘বন আইন, ১৯২৭’ এর ২৯ ধারার আওতায় রক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত।
এই ভূমিতে গর্জন, চাপালিশ, তেলসুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং হাতি, বানর, বন্য শুকরসহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এ বনভূমিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা নিষেধ। এছাড়া বনভূমি ইজারা দেওয়া বা না দেওয়ার এখতিয়ার কেবল বন বিভাগের।
কিন্তু বিগত সরকারের আমলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ নেয় ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে। বরাদ্দ দিতে ভূমি মন্ত্রণালয় জায়গাটিকে ‘অকৃষি খাসজমি’ হিসেবে দেখায়।
রেকর্ডে ‘রক্ষিত বন’ উল্লেখ না থাকায় বন বিভাগ এ বিষয়ে মামলা করেন। পাশাপাশি ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল চেয়ে একটি রিট মামলাও হাইকোর্টে দায়ের করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ বন্দোবস্তের বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেন, যা আপিল বিভাগে বহাল রয়েছে।
১৯৯৯ সালে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন ঝিলংজা ইউনিয়নকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে বনভূমির গাছ কাটাসহ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন নিষিদ্ধ করা হয়। ৭০০ একর রক্ষিত বনও এই সংকটাপন্ন এলাকার অন্তর্ভুক্ত।
দখলদারদের তালিকা প্রস্তুতকারক কর্মকর্তা ও কক্সবাজার রেঞ্জের (সদ্য বিদায়ী) রেঞ্জ কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন সাহা ৮৬৫ দখলদারের তালিকা প্রস্তুতের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, বাতিলকৃত ৭০০ একর কাঁচা, আধাপাকা, ঝুপড়িসহ ১৫শ’র মতো ঘর-বাড়ি রয়েছে। ওই জমিতে নানাবিধ উদ্যোগের প্রস্তাব তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ৭০০ একর বনভূমিতে বিলুপ্ত প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়ন সৃজন করে ‘ফরেস্ট জিনপুল সংরক্ষণ কেন্দ্র’ সৃষ্টির লক্ষ্যে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রধান বনসংরক্ষক ওই এলাকা পরিদর্শন শেষে নামকরণসহ প্রস্তাবনা প্রেরণের নির্দেশ দেন। তার আলোকে নানাবিধ প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, উচ্ছেদের আগেই যদি দখলদারদের পুনবাসন করা না হয় তাহলে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি ৭০০ একরের বাহিরে থাকা বনভূমিতে স্থাপনা গড়ে উঠার আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. নূরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, উচ্ছেদ তালিক তৈরি নানাবিধ প্রস্তাবনা তৈরি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। এবং উচ্ছেদের সহযোগিতা চেয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসককেও চিঠি দেয়া হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে সহযোগিতা পেলে অভিযান পরিচালিত হবে।
তিনি বলেন, উচ্ছেদের পর ওই জমিতে বিলুপ্ত হওয়া নানাবিধ গাছপালা লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্ উদ্দিন বলেন, বনবিভাগের চিঠি এখনো হাতে পাইনি। বনবিভাগ উচ্ছেদের ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইলে নিশ্চয়ই সহযোগিতা করা হবে।
এদিকে গত ১৫ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বরাবর উচ্ছেদের সহযোগিতা চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন বলে বনবিভাগের সূত্রে জানা গেছে