বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ক্রাইম জোন হিসেবে খ্যাত কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বহিস্কৃত হয়েও বেআইনিভাবে গত ১৩ মাস যাবত দায়িত্ব পালন করার অভিযোগ উঠেছে।
ফৌজদারি মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামী হওয়ায় ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করে পরিপত্র জারি করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
সিনিয়র সহকারী সচিব জেসমীন প্রধান স্বাক্ষরিত ঐ পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজারে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ৩টি মামলার অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হওয়ায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর ৩৪(১) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ২০২৩ সালের ২ আগষ্ট উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি প্রেরণ করেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান।
২০২৩ সালের ১৩ জুলাই উখিয়ার পালংখালীর ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে চারটি মামলায় আদালতে অভিযোগ পত্র গৃহীত হওয়ায় উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন স্থানীয় সরকার বিভাগকে বিষয়টি জানানো হয়। পরে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেন সচিব বরাবরে।
এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী কর্তৃক সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম ইউনিয়ন পরিষদসহ জনস্বার্থের পরিপন্থী বিবেচনায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর ৩৪(১) ধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যানের স্বীয় পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানানো হয় পরিপত্রে।
পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে শরণাপন্ন হয়ে রিট পিটিশন দাখিলের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের বহিস্কারাদেশ স্থগিত করা হয়েছে মর্মে একটি লয়্যার্স সার্টিফিকেট নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন আলোচিত এই ইউপি চেয়ারম্যান।
প্রচলিত নিয়মে জরুরি ক্ষেত্রে আদালত কিংবা প্রশাসনিক দপ্তরে কোনো লয়্যার্স সার্টিফিকেট দাখিল করা হলে তার মেয়াদ থাকে ১০ থেকে ১৫ দিন।
এরপর একবছর অতিবাহিত হলেও উচ্চ আদালতের আদেশের কপি বা মন্ত্রণালয় কতৃক স্বপদে বহাল হওয়ার কোন আদেশের কপি তিনি জেলা প্রশাসক/উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর জমা দেননি।
বিষয়টি জেনেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে নিরব ভূমিকায় থাকে স্থানীয় প্রশাসন। তবে, সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর দেওয়া পালংখালী ইউনিয়নের জনৈক সাইফুল ইসলাম বাবুল কতৃক এসংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে শুরু হয় তদন্ত।
এ প্রসঙ্গে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন বলেন, ” গত ২৯ আগস্ট অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি তদন্তের জন্য ট্যাগ অফিসার হিসেবে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার বদরুল আলমকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। তিনি এখনো প্রতিবেদন দাখিল করেননি।”
দায়িত্ব পাওয়া তদন্ত কর্মকর্তা বদরুল আলম জানান, আইন অনুযায়ী ৬ মাস অন্তর অন্তর স্থগিতাদেশের সময়সীমা বর্ধিত করে, এখন পর্যন্ত তিনটি আদালতের আদেশ দাখিল করার কথা।
তদন্ত শুরুর আগ পর্যন্ত এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী একটি আদেশও জমা দেননি জানিয়ে বদরুল আলম বলেন, “এতোদিন কোনো কপি জমা না দিলেও প্রথম শুনানিতে গত ১৬ জুলাই জারিকৃত সেপ্টেম্বর-ফেব্রুয়ারি সময়কালের একটি আদেশ তিনি দেখিয়েছেন। ”
বাকি দুই আদেশের কপি এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর কাছে সংরক্ষিত আছে এবং তিনি দ্বিতীয় শুনানিতে জমা দিবেন মর্মে সময় চেয়েছেন বলে জানান বদরুল আলম।
তদন্ত শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আদালত কতৃক স্থগিতাদেশের কোনো কপি না পাওয়ায় নিয়মানুসারে এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর উপর আরোপিত বহিস্কারাদেশ বহাল রয়েছে।
তদন্তের প্রেক্ষিত এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন।
মুঠোফোনে তিনি প্রতিবেদককে বলেন,” বিষয়টি অবগত হয়েছি এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।”
অন্যদিকে নিজেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি দাবী করে এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ” আইনি কোন বাধা নাই আমার দায়িত্ব পালনে, সব আদেশের কপি আছে। পরাজিত একটি পক্ষ সবসময় আমার বিরুদ্ধে সব সময় লেগে আছে এগুলো তারই ষড়যন্ত্রের অংশ এবং তারা কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচনে আমাকে পরাজিত করতে পারবে না।” আমি টানা ৩ বার জনগণের ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান।
কারাগারে থাকা উখিয়া-টেকনাফের বিতর্কিত সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী।
২০১১ সালে বিএনপির সমর্থনের তিনি ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও,পরে বদির আর্শীবাদে উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদ ছেড়ে ২০১৬ ও ২০২১ সালে বির্তকিত ইউপি নির্বাচনে জয়লাভ করেন তিনি।
গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উখিয়া-টেকনাফ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া বদির স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন আক্তারের নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব থাকতে দেখা গেছে এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীকে।
সেসময় প্রচারণা চলাকালীন পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে নানা বক্তব্য রেখে নৌকার জন্য তিনি ভোট প্রার্থনা করেছিলেন।
এছাড়াও বদি শ্যালক উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর পক্ষে গত উপজেলা নির্বাচনেও গফুর উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন সক্রিয়।
সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে তিনি বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছেন বলে ইউএনও বরাবরে দায়েরকৃত লিখিত অভিযোগ সুত্রে জানা যায়।
প্রসঙ্গত, টানা তৃতীয় মেয়াদে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা আলোচিত জনপ্রতিনিধি এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী এর আগে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে সাময়িক বহিষ্কার হয়ে ছিলেন। সেসময় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শরীফা আহমেদ স্বাক্ষরিত পরিপত্রে বলা হয়ে ছিলো চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় দায়েরকৃত জিআর মামলা, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল মামলা ও উখিয়া থানার অপর এক মামলায় দেয়া অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হওয়ায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ এর ধারা ৩৪(১) মোতাবেক তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। উক্ত পরিপত্রের বরখাস্ত আদেশ পরে আদালতে স্থগিত করা হয়েছিলো।