লন্ডন, ১৬ মে – ব্রিটিশ পুরুষরা অভিবাসী নারীদের সন্তানের বাবা সাজার বিনিময়ে হাজার হাজার পাউন্ড অর্থ নিচ্ছেন বলে বিবিসির এক তদন্তে জানা যাচ্ছে।
জন্ম সনদপত্রে এসব পুরুষের নাম যুক্ত করার জন্য তাদের সর্বোচ্চ ১২,৫২৫ মার্কিন ডলার (১০,০০০ পাউন্ড) পর্যন্ত অফার করা হচ্ছে। এভাবে অভিবাসী শিশুদের ব্রিটেনের নাগরিকত্ব পেতে এবং অভিবাসী মায়েদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে।
জালিয়াতরা এই কাজে ফেসবুক ব্যবহার করছে এবং তারা দাবি করছে যে হাজার হাজার নারীকে তারা এভাবে সাহায্য করেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের নিয়ম অনুযায়ী এধরনের কন্টেন্ট পোস্ট করা নিষিদ্ধ।
বিবিসির টিভি অনুষ্ঠান নিউজনাইটের তদন্তে দেখা গেছে, ব্রিটেনজুড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে।
তদন্ত থেকে জানা যাচ্ছে, ব্রিটেনজুড়ে এজেন্টরা একাজে জড়িত রয়েছে এবং এরা অর্থের বিনিময়ে ভুয়া বাবা সাজাতে ব্রিটিশ পুরুষদের খুঁজে বের করছে।
বিবিসির তরফে একজন গবেষক একজন গর্ভবতী মহিলার ছদ্মবেশ ধরেছিলেন যিনি অবৈধভাবে ব্রিটেনের বসবাস করছেন। এই জালিয়াতি ব্যবসার সাথে জড়িত এমন কিছু লোকের সাথে এই গবেষক নিজে কথা বলেছেন যারা এধরনের ‘সেবা’ প্রদান করছেন।
থাই নামে পরিচিত একজন এজেন্ট তাকে জানিয়েছেন যে তার হাতে একাধিক ব্রিটিশ পুরুষ রয়েছেন যারা ভুয়া বাবা হিসাবে কাজ করতে রাজি এবং এর জন্য তিনি ১১,০০০ পাউন্ডের জন্য একটি “সম্পূর্ণ প্যাকেজ” অফার করেন।
ঐ এজেন্ট প্রক্রিয়াটিকে “খুব সহজ” বলে বর্ণনা করেন এবং বলেন যে শিশুটি যাতে ব্রিটিশ পাসপোর্ট পায় তার জন্য তিনি “সবকিছুই করবেন।”
থাই এসব কাজের জন্য ফেসবুকে কোন বিজ্ঞাপন দেননি। তিনি বলছেন, কর্তৃপক্ষের চোখে কার্যকরভাবে ধুলা দেয়ার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য গল্প তিনি তৈরি করবেন।
বিবিসির ছদ্মবেশী গবেষকের সাথে তিনি অ্যান্ড্রু নামে এক ব্রিটিশ পুরুষের পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি বলেছিলেন যে তিনি ভুয়া বাবা সাজতে রাজি আছেন। এজন্য অ্যান্ড্রুকে মোট ফি থেকে ৮,০০০ পাউন্ড দিতে হবে।
এই সাক্ষাতের সময় বিবিসির গবেষককে অ্যান্ড্রু তার পাসপোর্ট দেখান এবং প্রমাণ করেন যে তিনি ব্রিটেনের। ছদ্মবেশী গবেষকের সঙ্গে তিনি সেলফিও তোলেন। এই ভুয়া বাবা সাজানোর জালিয়াতিতে জড়িত কোনও এজেন্টকে বিবিসি কোনও নগদ অর্থ প্রদান করেনি।
পরে যখন বিবিসির সাংবাদিক এই জালিয়াতি ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে থাই নামের ঐ এজেন্টের মুখোমুখি হন, তিনি তখন কোনও অন্যায় কাজ করার বেমালুম অস্বীকার করেন এবং বলেন যে তিনি “এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।”
বিবিসি অ্যান্ড্রুর কাছ থেকে এনিয়ে মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করলেও তিনি তাতে সাড়া দেয়নি।
এই জালিয়াতিতে জড়িত আরেকজন নারী এজেন্ট, যিনি নিজেকে থি কিম নামে পরিচয় দেন, তিনি দাবি করেন যে হাজার হাজার গর্ভবতী অভিবাসী মহিলাদের তিনি এভাবে সাহায্য করেছেন। তিনি বলেন, তিনি একজন ব্রিটিশ পুরুষ জোগান দিতে পারবেন এবং একাজে “বাবার জন্য দশ হাজার” খরচ হবে, এবং তার ফি হবে ৩০০ পাউন্ড।
থি কিম বিবিসির গবেষককে জানিয়েছেন, “আমি যে সমস্ত পুরুষ ব্যবহার করি তাদের সবার জন্ম এখানে এবং এরা আগে কখনও কোনও শিশুর জন্য নিবন্ধন করেননি।” “আমি জানি কীভাবে সবকিছু সামাল দিতে হয়। শিশুর পাসপোর্ট পাওয়া নিয়ে আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। এটা অবশ্যই তাকে দেয়া হবে।”
পরে থি কিম-এর মন্তব্যের জন্য বিবিসির তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোন সাড়া দেননি।
ভুয়া বাবা সাজানোর এই কেলেঙ্কারিকে ব্রিটেনের একজন অভিবাসন আইনজীবী অ্যানা গঞ্জালেজ “অবিশ্বাস্য রকম বিস্তৃত” বলে বর্ণনা করেছেন। “এটি অত্যন্ত সুচারুভাবে পরিচালিত [দুর্নীতি], এবং একে মোকাবেলা করা অবিশ্বাস্য রকম কঠিন,” তিনি বলছেন। “একইভাবে এই নারীরা যে কতটা মরিয়া এবং যুক্তরাজ্যে বসবাসের অধিকার পাওয়ার জন্য তারা যে কত কিছু করতে প্রস্তুত, এটা তারই প্রমাণ।”
যদি কোন অভিবাসী মহিলা অবৈধভাবে ব্রিটেনে বসবাস করেন এবং ব্রিটিশ নাগরিক কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার রয়েছে এমন কোন পুরুষের দ্বারা তার সন্তানের জন্ম হয়, তাহলে আইনের আওতায় শিশুটি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পায়। শিশুটির মা তখন পারিবারিক ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন, যার মাধ্যমে তিনি ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থাকার অধিকার পান। এবং পরে যথাসময়ে পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন।
“এই আইনটি তৈরি হয়েছে শিশুদের সুরক্ষার জন্য, ব্রিটেনে বসবাসের কোন কাগজপত্র নেই এমন মহিলাদের ভিসা দেয়ার জন্য নয়,” বলছেন তিনি৷ “এটা আইনের কোনও ফাঁকফোকর নয়। একে এভাবে দেখা উচিত নয়।”
ভুয়া বাবা সাজানোর এই জালিয়াতি ব্যবসার মাত্রা কতটা বিস্তৃত বিবিসির পক্ষে তা অনুমান করা সম্ভব হয়নি, কারণ ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যাকে বলা হয় হোম অফিস, এনিয়ে কতগুলো কেসে তদন্ত করেছে সেই তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি।
ব্রিটিশ শিশুদের ব্রিটিশ নয় এমন ক’জন অভিভাবককে ভিসা দেয়া হয়েছে সেই পরিসংখ্যানও তারা প্রকাশ করে না।
তবে গত বছর “অন্যান্য নির্ভরশীলদের” জন্য ৪,৮৬০টি পারিবারিক ভিসা মঞ্জুর করা হয়েছিল। এটি এমন একটি খাত যার মধ্যে ব্রিটিশ শিশুদের পিতামাতা হিসাবে ব্রিটেনে থাকার জন্য আবেদনকারীরাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ব্রিটেনে ইচ্ছাকৃতভাবে জন্ম সনদে মিথ্যা বিবরণ দেয়া একটি ফৌজদারি অপরাধ। হোম অফিস বিবিসিকে বলেছে, ভুয়া জন্ম সনদপত্র ব্যবহার করে অভিবাসন জালিয়াতি প্রতিরোধ ও সনাক্ত করতে তাদের ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।
ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “একমাত্র জন্ম সনদপত্রই পিতৃত্বের প্রমাণের যথেষ্ট প্রমাণ বলে বিবেচিত নাও হতে পারে” এবং যে ক্ষেত্রে এটি প্রমাণ করা প্রয়োজন, “সন্তোষজনকভাবে আমাদের অনুসন্ধান সম্পন্ন করার জন্য অতিরিক্ত প্রমাণ দাখিলের অনুরোধ করা যেতে পারে।”
তবে এসব ব্যাপারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা তা মনে করেন না অভিবাসন আইনজীবী হারজাপ: “এটি বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়, এমন হতে পারে হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে … হোম অফিস বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।” ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া এবং শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে এবং বহু বছর ধরে এসব চলছে।
নিউজনাইটের তদন্তে দেখা গেছে, ব্রিটেনে ভিয়েতনামী চাকরিপ্রার্থীদের কিছু ফেসবুক গ্রুপেও এধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে।
আমরা এসব অ্যাকাউন্ট থেকে এমন কয়েক ডজন পোস্ট পেয়েছি যেখানে উপযুক্ত ‘নকল বাবা’ সাজা নিয়ে পুরুষরা গর্ব করছেন এবং সেইসাথে নারীরা খুঁজছেন এমন ব্রিটিশ পুরুষ যারা ‘নকল বাবা’ সাজতে রাজি হবেন।
একটি অ্যাকাউন্টের পোস্টে বলা হয়েছে: “আমি চার মাসের গর্ভবতী। নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য বাবা সাজাতে আমার একজন ২৫-৪৫ বছর বয়সী লোকের খুবই প্রয়োজন।”
অন্য একটি পোস্টে লেখা হয়েছে: “আমি লাল বই [ব্রিটিশ পাসপোর্টের জন্য ভিয়েতনামি স্ল্যাং] সহ একজন বাবা। আপনি যদি গর্ভবতী হন এবং সন্তানের বাবা খুঁজে না পান তাহলে আমাকে ডিএম ডিরেক্ট মেসেজ করুন।”
ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা বলছে , “দত্তক নেয়ার আবেদন কিংবা জন্ম সনদপত্র জালিয়াতির” কোন পোস্ট দেয়ার অনুমতি ফেসবুক দেয় না। কোম্পানিটি বলছে, তাদের নীতিমালা লঙ্ঘন করছে এমন সব কন্টেন্টের অপসারণ কাজ তারা চালিয়ে যাবে৷
আমরা একজন মহিলার সাথে কথা বলেছি যিনি আমাদের জানিয়েছেন যে সন্তানের পিতা সাজানোর জন্য তিনি একজন পুরুষকে ৯,০০০ পাউন্ড দিয়েছেন। তিনি বলেন: “সে আমার চেয়ে ৩০ বছরের বড় ছিল। আমি শুনেছি যে সে আগেও অন্য এক মহিলার সাথে এই কাজ করেছে।”
এই নারী বলেন, লোকটির সাথে তার খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না। এই জুটি শুধুমাত্র তিনবার দেখা করেছে, একবার যখন তারা জন্ম সনদপত্র জোগাড়ের সময় রেজিস্টার অফিসে গিয়েছিল। অন্য একজন মহিলা আমাদের বলেছেন, বাবা সাজাতে তিনি একজনকে ১০,০০০ পাউন্ড দিয়েছিলেন। তবে তিনি পরে জানতে পারেন যে ঐ ব্যক্তি তার ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলেছিলেন।
“আমার শিশুর বার্থ সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার একদিন পরই আমি জানতে পারি যে আসলে তার নাগরিকত্বই নেই। আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ আমি ইতিমধ্যেই জন্ম সনদে তার বিবরণ লিখে রেখেছিলাম। এটা পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল না।” তার শিশুর নিবন্ধিত পিতা হিসাবে ঐ নারী একজন অপরিচিত ব্যক্তির নাম ব্যবহার করছেন এবং ব্রিটেনে বসবাসের জন্য তিনি ও তার সন্তান এখনও কোন অনুমতি পাননি।
আইনজীবী হারজাপ ভাঙ্গাল বলছেন, হোম অফিসকে আরও বেশি করে সন্দেহজনক ভিসা আবেদনপত্র তদন্ত করে দেখতে হবে। “যদি কোনও শিশু নিজেকে ব্রিটিশ বলে দাবি করে এবং তার পিতামাতার একজন ব্রিটিশ হয় থাকে ও অন্য অভিভাবকের কাছে ভিসা না থাকে – তাহলে এটি ডিএনএ পরীক্ষার জন্য একটি নিখুঁত কেস হওয়া উচিত।” তবে ব্রিটেনে জন্ম নিবন্ধন করার সময় কিংবা সন্তানের ব্রিটিশ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার সময় ডিএনএ পরীক্ষার কোনও প্রয়োজন নেই। এধরনের অপরাধের জন্য খুব বেশি লোকের বিচার হচ্ছে না। “আর এজন্যই লোকেরা এসব করছে – কারণ শাস্তির কোনও ভয় তাদের নেই।”
সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
আইএ/ ১৬ মে ২০২৩