শিরোনাম ::
মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫৬ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

মুন্নীর অমীমাংসিত কাব্য – DesheBideshe

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫




টরন্টোর ভিক্টোরিয়া পার্ক আর ড্যানফোর্থের আশপাশে বাঙালিদের একটি ছোট্ট আবাসিক এলাকা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে টিসডেল প্লেসের বহুতল ভবনগুলো হয়ে উঠেছে অভিবাসী বাঙালিদের স্বপ্নের ঠিকানা। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে এখানে এসে অনেকেই গড়ে তুলছেন নতুন ঘরসংসার। সেই নতুন জীবনে আছে অনেক স্বপ্ন, আছে অজস্র আকাঙ্ক্ষা। নতুন স্বপ্ন নিয়ে আসা বাঙালি গৃহবধূরা সংসার সামলায়, বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায়, গল্পে-আড্ডায় ভুলে থাকার চেষ্টা করে জন্মভূমির ফেলে আসা স্মৃতি। এখানে প্রতিদিন নতুন জীবন শুরু করার গল্প বুনে বহু পরিবার।

এমনই এক স্বপ্ন নিয়ে একদিন কুলাউড়ার মেয়ে শাহনাজ ফেরদৌস মুন্নী পা রেখেছিল এই অচেনা শহরে। তার চোখে ছিল ভবিষ্যতের ঝলমলে স্বপ্ন, নতুন জীবনের হাজারো পরিকল্পনা। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে মুন্নী ছিল সকলের বড়। স্বামী আব্দুল লতিফের হাত ধরে যখন প্রথমবার বিমান থেকে নেমেছিল সে, তখনই সে অনুভব করেছিল এক নতুন জীবনের স্পন্দন। মুন্নীর মনে ছিল একটি ছোট্ট সুখী সংসারের ছবি— স্বামী-সন্তান নিয়ে নির্মল ভালোবাসায় ঘেরা একটি নিরাপদ আশ্রয়।

মুন্নীর প্রতিদিন শুরু হতো নতুন উদ্দীপনায়। দিন কাটত পরিবারের সেবা, রান্নাবান্না, আর নতুন বন্ধুদের সাথে গল্পে। টিসডেল প্লেসের আশেপাশের প্রতিবেশীরা ছিল যেন তার আরেক পরিবার। প্রতিদিন বিকেলে জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখত মুন্নী— সেখানে দেখা যেত গাছের ডালে বসা ছোট ছোট পাখি, বিকেলের রোদে ঝলমলে পাতার স্নিগ্ধ আলো। সেই প্রকৃতির দৃশ্য যেন মুহূর্তের জন্য হলেও তাকে ভুলিয়ে দিত দেশের কথা।

২০০১ সালের ৭ অক্টোবর। টরন্টোর এ রাতটি ছিল অন্যরকম। আকাশের বুক জুড়ে ছিল গাঢ় নীলাভ মেঘের ভিড়, বাতাসে ছিল মৃদু শীতের পূর্বাভাস। চারদিকে নীরবতার মাঝে মাঝে এক-আধটি গাড়ির শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যেত না। ৩০ টিসডেল প্লেসের সেই উঁচু ভবনটিতে প্রতিটি জানালার আলো নিভে যাচ্ছিল একে একে, শহরটি যেন তলিয়ে যাচ্ছিল এক গভীর ঘুমের দেশে।

খবরটি মুহূর্তেই পৌঁছে যায় মুন্নীর জন্মস্থান মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। পুরো এলাকায় যেন শোকের মাতম উঠল। মুন্নীর বাবা খুরশেদ আলমের চোখে ছিল শুধু শূন্যতা। তিনি ছিলেন কুলাউড়ার রাউৎগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের শ্রদ্ধাভাজন প্রধান শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রী থেকে এলাকাবাসী— সবাই বলছিল, এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা এর আগে কোনোদিন শুনেনি তারা।

তদন্ত চললো দীর্ঘদিন। পুলিশের সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ল মুন্নীর স্বামী আব্দুল লতিফের ওপর। ঘটনার দুই বছর পর, ২০০৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আব্দুল লতিফকে পুলিশ গ্রেফতার করে। শুরু হল আদালতের দীর্ঘ লড়াই। আদালতে দাঁড়িয়ে আব্দুল লতিফ বলেছিলেন, সেই রাতে বাসায় ফিরে তিনি বিছানায় শুয়ে সিগারেট খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেই সিগারেট থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনের ধোঁয়া ও তাপে ঘুম ভাঙলে তিনি মুন্নীকে প্রাণপণে জাগানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কন্যা লুবাবাকে নিয়ে কোনোমতে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন তিনি। কন্যাকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে আসতে পারলেও বাঁচাতে পারেননি তার প্রিয়তমা স্ত্রী মুন্নীকে।

সরকারের পক্ষের এটর্নি লিসা আরল বলেন, ‘একই ফ্ল্যাটে একই সময়ে থাকা অবস্থায় দু’জন অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পায় এবং একজন মারা যায়, এটি রহস্যময়।’ বিচারক কানিংহাম দীর্ঘ শুনানি ও মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে বলেন, আব্দুল লতিফ যে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে, এর কোনো প্রমাণ নেই। অভিযোগের বিরুদ্ধে আনীত মামলাটি একটি অতি দুর্বল মামলা বলে তিনি অভিহিত করেন। বিশিষ্ট প্যাথোলজিস্ট ড. ডেভিড চিয়ারসন বলেন, নিহতের কারণ সুনিশ্চিত নয়। মুন্নী কি অগ্নিকাণ্ডের আগেই মারা যায়, নাকি অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে, সেটি নিশ্চিত নয়। তিন বছর পর আব্দুল লতিফকে নির্দোষ ঘোষণা করে আদালত।

মুন্নীর মৃত্যু রয়ে গেল একটি অমোচনীয় বেদনার গল্প হয়ে। টরন্টোর আকাশে এখনও সেই রাতের অন্ধকারের মতোই জমে আছে অজস্র প্রশ্ন। শহরের বাতাসে এখনও ঘুরে বেড়ায় মুন্নীর অকাল প্রয়াণের কাব্য, মুন্নীর হাসি, মুন্নীর দীর্ঘশ্বাস, তার বেঁচে থাকার আকুতি।



আরো খবর: