সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৪:২১ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

একটি রক্তাক্ত চিরকুট! – DesheBideshe

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫




মন্ট্রিয়ল। শীতকালে সাদা তুষারের চাদরে শহরটি ঢাকা পড়লেও অভিবাসীদের ব্যস্ততা কখনো কমে না। এখানে সবাই জীবন গুছিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে ব্যস্ত। কেউ ট্যাক্সি চালায়, কেউ রেস্তোরাঁয় কাজ করে, কেউবা সরকারি চাকরিতে ঢুকে স্বপ্ন দেখে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। সেই ব্যস্ত শহরের এক অংশে বাস করে পারভীন আক্তার; যার জীবনটা বাইরে থেকে স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে জমে আছে হাজারো গোপন ক্ষত। তার স্বামী নাজমুল হাসান প্রায় সাত বছর ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন মন্ট্রিয়লে। মাত্র দুই মাস আগে পারভীন স্বামীর কাছে এসেছে, সংসার গুছিয়ে নেওয়ার আশায়। কিন্তু সে জানে, তার জীবন স্বাভাবিক হবে না। একটি নাম, একটি সম্পর্ক, তার বুকের ভেতর এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হয়ে আটকে আছে- আরিফুল ইসলাম।

পারভীন আরিফুলকে ভালোবাসত, কিন্তু সেই ভালোবাসা তাকে এক ভয়ংকর জালে ফেলে দেয়। নরসিংদীর কলেজে পড়ার সময় পারভীনের পরিচয় হয়েছিল আরিফুলের সঙ্গে। প্রথম দিকে ছিল বন্ধুত্ব, পরে সেই সম্পর্ক গভীর হয়। আরিফ ছিল স্বপ্নবাজ, আত্মবিশ্বাসী, স্মার্ট একজন তরুণ, যার কাছে জীবন মানে উপভোগ করা। পারভীন-আরিফের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হয়, তারা নিয়মিত দেখা করতে শুরু করে। প্রথমে নরসিংদীতে, পরে ঢাকায়। হোটেলে রাত কাটানোর অভ্যাস হয়ে ওঠে স্বাভাবিক।

কিন্তু পারভীন জানত না, আরিফুল কেবল প্রেমের নামে শারীরিক সম্পর্কটাই চেয়েছিল। প্রতিবার তারা যখন হোটেলে রাত কাটাত, আরিফ গোপনে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করত। প্রথমে পারভীন বুঝতে পারেনি, কিন্তু একসময় যখন সে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, তখনই শুরু হলো ভয়ংকর ব্ল্যাকমেইলিং। আরিফ প্রথমে শুধু ভয় দেখাত, পরে টাকা দাবি করা শুরু করলো। পারভীন বাধ্য হয়ে টাকা দিত, কারণ সে জানত, যদি ভিডিওগুলো ফাঁস হয়ে যায়, তবে তার জীবন শেষ হয়ে যাবে। পরিবার, সমাজ, স্বামী সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।

২০১৬ সালে নরসিংদীর ঘোড়াদিয়া এলাকার নাজমুল হাসানের সঙ্গে পারভীনের বিয়ে হয়। নাজমুল ছিল একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক, যে বিদেশে গিয়ে নিজের জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছিল। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই সে কানাডায় চলে যায় এবং পারভীন দেশে থেকে যায়। এই দূরত্বই সুযোগ করে দেয় আরিফুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠার। নাজমুল হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু সে কখনোই প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। সে ভেবেছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

এরপর আরিফুল হঠাৎ করেই জাপানে চলে যায়। তার নতুন স্বপ্ন ছিল বিদেশে স্থায়ী হওয়া। বাংলাদেশি এক পরিচিত বন্ধুর সাহায্যে কাজ নেয় একটি রেস্টুরেন্টে। সেই সময় তার পরিচয় হয় নাচুকি নামের এক জাপানি তরুণীর সঙ্গে। নাচুকি ছিল ভীষণ প্রাণোচ্ছল। সে আরিফের ব্যক্তিত্বের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়ে। পরিচয় থেকে প্রেম, তারপর বিয়ে। নাচুকি ইসলাম গ্রহণ করে, নিজের নাম পাল্টে রাখে আয়েশা। তাদের সংসার ছিল ভালোবাসায় পূর্ণ। সে জানত না, তার স্বামীর অতীতে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর অধ্যায়।

এদিকে পারভীন ভেবেছিল, সব শেষ। নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করবে। কিন্তু ২০২৪ সালের শুরুর দিকে আবারও শুরু হয় সেই পুরোনো দুঃস্বপ্ন। আরিফ এবার হুমকি দিয়ে বলে পারভীন যদি তার কাছে না আসে, তবে তার গোপন ভিডিও তার স্বামী ও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেবে। প্রথম প্রথম সে হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত থাকত, কিন্তু একদিন সত্যিই কিছু ভিডিও পাঠিয়ে দেয় নাজমুলের কাছে।
সেই রাতে পারভীন তার স্বামীর চোখের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। নাজমুলের হাতে মোবাইল, স্ক্রিনে ভেসে উঠছে অতীতের লজ্জার মুহূর্তগুলো। নাজমুল স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘তুমি যা করেছ, তা মিটমাট করে ফেলো। ওকে বোঝাও, সব মুছে ফেলতে বলো।’ পারভীন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

এবার পারভীন একটি পরিকল্পনা করে। আরিফের সাথে শেষ বোঝাপড়া করার জন্য সে ১৬ মে কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসে। আরিফুলকেও ঢাকায় আসতে বলে। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে, যদি সবকিছু ঠিক না হয়, তবে সে আত্মহত্যা করবে। ক্ষণিক পরে সে সিদ্ধান্ত নেয়, যদি বোঝাপড়া না হয় তবে সমস্যার মূল কারণকেই সে সরিয়ে দিবে।

১৭ মে বিকেল ৪টা ৯ মিনিটে আরিফুল ঢাকায় এসে বসুন্ধরার ‘এয়ার বিএনবি’র একটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে ওঠে। অনলাইনে ফ্ল্যাটটি সাতদিনের জন্য ভাড়া করেছিলেন আরিফুল। সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, সেদিন বিকেলেই পারভীন সেখানে যায়। দুজনের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ হয়। পারভীন বারবার অনুরোধ করছিল, যেন আরিফ তার ভিডিও মুছে ফেলে। কিন্তু আরিফ এ কথা, সে কথা বলে পাশ কাটিয়ে যায়। কথা কাটাকাটি, অনুনয়-বিনয়। এটা স্পষ্ট আরিফ কিছুতেই পারভীনকে মুক্তি দিতে রাজি নয়। রাত বাড়তে থাকে।

গভীর রাত। পারভীন ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে। ক্লান্ত আরিফুলও গভীর ঘুমে চলে যায়। এই ঘুম বুঝি তার শেষ ঘুম! এক পর্যায়ে পারভীন বিছানা থেকে উঠে ছুরি হাতে নেয়। প্রথমে তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে দ্বিধা কাটিয়ে আরিফের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপর্যপুরি ছুরিকাঘাত করতে থাকে আরিফের গলায়, বুকে, পেটে। মিশন কমপ্লিট! সব শেষ।

রক্তমাখা ছুরি হাতে পারভীন বিছানার পাশে বসে পড়ে। সে জানত, এই খুনের জন্য হয়তো তাকে পুরো জীবন পালিয়ে থাকতে হবে। সে একটি চিরকুট লিখে। যাতে লেখা ছিল ‘আমার জীবনের শান্তি নষ্ট করে দিছে এই রেপিস্ট, ব্ল্যাকমেলার। সে তার নিজের ইচ্ছায় আমার হাতে ধরা দিছে। নিজের হাতে এই রেপিস্ট, ব্ল্যাকমেলারকে মেরে শান্তি নিলাম।’

১৮ মে সকাল সাড়ে ৬টায় পারভীন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়। সরাসরি শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়ে কুয়েত এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ধরে কানাডায় ফিরে আসে।



আরো খবর: