২০১৯ সালের গ্রীষ্মের কোন এক বিকেল। ভয়াবহ এক ঘটনা ঘটে যায় টরন্টো নগরীর পূর্বপ্রান্তে। মেনহাজ নামে এক যুবক হত্যা করে তার মা, বাবা, বোন ও নানীকে। ১২ ঘণ্টা পর পুলিশ এসে উদ্ধার করে চারজনের মৃতদেহ। গ্রেফতার করা হয় মেনহাজকে। এই ঘটনায় সমগ্র কানাডা জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গোটা দক্ষিণ এশিয় কমিউনিটিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়।
১৯৮০ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় আসেন তরুণ, স্বপ্নবাজ মনিরুজ্জামান। তার জীবন ছিল সাদামাটা। নব্বই এর শেষদিকে তিনি দেশে যান এবং মা-বাবার পছন্দের পাত্রী মমতাজ বেগমকে বিয়ে করে কানাডায় নিয়ে আসেন। তাদের দুই সন্তান। ছেলে মেনহাজ জন্ম নেয় ১৯৯৬ সালে। এর দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে মেয়ে মালেসা জন্ম গ্রহণ করে।
মমতাজ ছিলেন এক প্রাণবন্ত নারী, যিনি পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি ছিলেন খুবই যত্নশীল। আপ্যায়ন করতে ভালবাসতেন। যখন তিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে খেতে যেতেন, তখন প্রায়ই তিনি বিল পরিশোধ করতেন। যে বন্ধুরা প্রয়োজনে যানবাহনের সুবিধা পেতেন না, তাদের ডাক্তার কিংবা জেরার্ড স্ট্রিটের লিটল ইন্ডিয়াতে নিয়ে যেতেন। তার স্বামী ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্তর্মুখী, বিনয়ী, পরিশ্রমী এবং ধর্মবিশ্বাসে গভীরভাবে নিবেদিত। মনিরুজ্জামান ছিলেন একজন পরিশ্রমী ট্যাক্সিচালক। তিনি Beck কোম্পানির ট্যাক্সিচালক হিসেবে কাজ করতেন, যেখানে তিনি কয়েকবার কোম্পানির মাসের সেরা চালকদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেন। প্রথমে স্কারবরোর ম্যাকওয়ান রোডে একটি বাড়ি কেনেন তারপর স্কারবোরোতে একটি কনডো এবং ড্যানফোর্থে আরও একটি বাড়ি কেনে ভাড়া দেন। মমতাজ ভাড়ার সম্পত্তিগুলোর দেখাশোনা করতেন। ২০০৬ সালে, তারা মারখামের ক্যাসলমোর অ্যাভিনিউতে একটি বড় চার বেডরুমের বাড়ি কিনেন, যার সঙ্গে একটি বুরুজ ছিল। তার নিকট বন্ধুরা বলেন, মনিরুজ্জামান দম্পতি কঠোর পরিশ্রম করতেন পারিবারিক মূল্যবোধ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মান ধরে রাখার জন্য।
উইকএন্ডে এ পরিবারটির সময় কাটতো বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে, পিকনিকে, সিনেমা দেখায় বা শপিং সেন্টারে। তাদের দুটি সন্তানকেও বড় করছিলেন তারা খুব যত্ন করে। মমতাজ তার বন্ধুদের কাছে তাদের সাফল্যের গল্প শোনাতেন। মনিরুজ্জামান চেয়েছিলেন মেনহাজ একজন ইঞ্জিনিয়ার হোক, আর মালেসার স্বপ্ন ছিল নিউরোসার্জন হওয়ার।
মেনহাজ ছোটবেলা থেকেই ছিল চুপচাপ, অন্তর্মুখী। যার ছেলেমানুষী চেহারার সঙ্গে ছিল চশমা পরা একটি শান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। সে ছিল তার বাবা-মায়ের প্রিয় সন্তান, বিশেষ করে তার মা তাকে খুব আদর করতেন। বন্ধুদের মতে, সে প্রায় সবসময়ই বাড়িতে থাকত: তার মা প্রতিদিন দুপুরের খাবারের জন্য তাকে স্কুল থেকে আনতেন, এবং যদি তিনি জানতেন যে মেনহাজ বাড়িতে আছে তাহলে তিনি সামাজিক অনুষ্ঠান ছেড়েও আগেভাগেই বাড়িতে চলে আসতেন।
বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক দেখালেও, সকলের অজান্তে মেনহাজ ভেতরে ভেতরে ক্রমশ নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিলো। প্রথম বছরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস মিস করা শুরু করে মেনহাজ। কিন্তু পরিবারের কাছে সে গল্প ফেঁদেছিল যে সে স্কলারশিপ পেয়েছে, ভালো নম্বর করেছে। বাস্তবে, সে ব্যর্থ হচ্ছিল। অবশেষে, সে পুরোপুরি পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাবা-মাকে সে কিছুই বুঝতে দেয়নি সে। প্রতিদিন সকালে ব্যাগে ল্যাপটপ নিয়ে বের হতো, বাসে উঠত, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে চলে যেত শপিং সেন্টারে। ফুড কোর্টে বসে, ল্যাপটপ খুলে হারিয়ে যেত ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।
২০১৯ সালের গ্রীষ্মে, ক্যাসলমোরের বাড়ির পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। একদিকে মেনহাজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার সংবাদ, অন্যদিকে মমতাজ ও মনিরুজ্জামানের ২৫তম বিবাহবার্ষিকী।
দুটি বড় আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রথমটি ছিল ২৮ জুন, যেখানে ৪০ জন বন্ধু জামান পরিবারের পেছনের উঠোনে জড়ো হয়েছিল। দ্বিতীয় পার্টি ছিল মার্কহাম কনভেনশন সেন্টারে, যেখানে ১০০ জন অতিথি উপস্থিত ছিলেন। মেনহাজ সেখানে একটি বক্তৃতা দিল। সে অতিথিদের বলল, ‘আমি কতটা ভাগ্যবান, এমন উদার ও দয়ালু বাবা-মা পেয়েছি।’ সবাই হাততালি দিল এবং তার প্রশংসা করতে লাগলো।
মেনহাজ তার বাবা-মাকে বলেছিল, সে ২৮ জুলাই যান্ত্রিক প্রকৌশলে স্নাতক হতে যাচ্ছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, তারা উদগ্রীব হয়ে এ দিনটির অপেক্ষা করছিলেন। বন্ধুদের তারা বলেছিলেন, ‘আমরা কতটা গর্বিত হব, যখন আমাদের ছেলে মঞ্চে উঠে সনদ গ্রহণ করবে!’ অনেকেই মেনহাজকে আদর্শ সন্তান বলে মনে করত। এক পারিবারিক বন্ধু বললেন, ‘আমি প্রায়ই আমার স্ত্রীর কাছে বলতাম, আমাদের সন্তানরা কেন ওদের মতো হতে পারে না?’ ওরা এত ভদ্র ছিল।
এদিকে মেনহাজ তিন বছর ধরে এই প্রতারণা চালিয়ে যেতে যেতে সিদ্ধান্ত নেয়, এভাবে আর চলতে পারে না। এক ভয়ংকর বিকল্প পথ বেছে নেয় সে।
মমতাজের মা, ফিরোজা, যিনি কিছুদিন আগে অভিবাসন নিয়ে টরন্টোতে এসেছিলেন। সে রাতে, মা-মেয়ে একসঙ্গে মাস্টার বেডরুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কোনো এক সময়, মেনহাজ হাতে একটি কুড়াল নিয়ে তার বাবা-মায়ের ঘরে প্রবেশ করে। তারপর সে কুড়ালটি দিয়ে তার মায়ের মাথায় আঘাত করে। এরপর সে তার নানীর ওপর হামলা চালায়। তারপর সে নিজের ল্যাপটপে ফিরে যায়।
‘আমি এখন পর্যন্ত মা এবং নানিকে হত্যা করেছি, ৫ মিনিটের মধ্যে বোনকে এবং ১ ঘণ্টার মধ্যে বাবাকে হত্যা করার অপেক্ষায় আছি,’ মেনহাজ ডিসকর্ডের চ্যাট উইন্ডোতে টাইপ করল। কয়েক মিনিট পর, মালেসা সামনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকল। মেনহাজ তার মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করল এবং তাকে মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রাখল। মালেসার শার্টে তখনও গ্রোসারি স্টোরের তার নামের ব্যাজ লাগানো ছিল।
এরপর, মেনহাজ আবার তার ল্যাপটপে ফিরে গেল, ডিসকর্ডে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করতে থাকল। মধ্যরাত নাগাদ, সে তার বাবার ট্যাক্সির হেডলাইট দেখতে পেল, গাড়ি ধীরে ধীরে ড্রাইভওয়েতে ঢুকছে। মেনহাজ কম্পিউটার থেকে উঠে দাঁড়াল এবং গ্যারেজে তার বাবার মুখোমুখি হলো। সে একই কুড়াল দিয়ে তার বাবার ওপর আক্রমণ করল। তদন্তে জানা যায়, সে তার পরিবারের চারজনের গলাও কেটে দেয় রান্নাঘরের একটি ছুরি দিয়ে, সম্ভবত নিশ্চিত করার জন্য যে তারা মারা গেছে।
এরপর, সে নিজের কম্পিউটারে আবার ফিরে আসে। ‘আমি এখন আমার পুরো পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেছি,’ সে বন্ধুদের লিখল। প্রথমে, তারা ভাবল সে মজা করছে। কিন্তু যখন সে মৃতদেহগুলোর ছবি পাঠানো শুরু করল, তখন তারা বুঝল সে সত্যিই এটা করেছে।
একজন গেমার, যিনি তিউনিসিয়ায় থাকেন, প্রথমে ভেবেছিলেন এটি একটি বিকৃত রসিকতা। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন মেনহাজ নিজের হাতে রক্তমাখা ছুরি ধরে একটি সেলফি তুলেছে, তখন তিনি ক্রাইম স্টপারস ইন্টারন্যাশনালকে ফোন করলেন। খেলোয়াড়দের কেউই জানত না সে কোথায় থাকে; তারা শুধু জানত, সে একজন কানাডিয়ান। তারা দ্রুত একটি আলাদা ডিসকর্ড গ্রুপ তৈরি করল, যার উদ্দেশ্য ছিল তার আইপি ঠিকানা ট্র্যাক করা এবং পুলিশকে জানানো। বিয়ানকা নামে একজন টরন্টোর গেমার শেষ পর্যন্ত মেনহাজের পেপ্যাল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তার ঠিকানা খুঁজে পায়। তিনি ইয়র্ক রিজিওনাল পুলিশকে ফোন করেন। বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ ক্যাসলমোর অ্যাভিনিউর বাড়িতে এসে মেনহাজকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে প্রথম-ডিগ্রি খুনের চারটি অভিযোগ আনা হয়।
সেই রাতেই কানাডা জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে। মার্খামের ক্যাসলমোর অ্যাভিনিউর একটি বাড়িতে চারজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। টেলিভিশনের পর্দায় জামান পরিবারের বাড়ির ছবি ভেসে উঠল। তাদের আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধুরা পাগলের মতো ফোন করতে লাগলেন। কিন্তু তাদের ফোন শুধু বেজেই চলছিলো, কেউ ধরার মতো ছিলো না।
এই ঘটনায় পুরো দক্ষিণ এশিয় সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অভিভাবকদের মনে অনেক প্রশ্ন জেগে উঠে। মেনহাজ কি দীর্ঘদিন ধরে বিষন্নতায় ভুগছিল? এটি কতদিন ধরে চলছিল? এটি কি প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না? বাবা-মা হিসেবে কোথায় তারা ব্যর্থ হলেন? সন্তানের সংকেত কি তারা উপেক্ষা করেছেন? কারও কাছে কোনো নিশ্চিত উত্তর ছিল না। অনেক অভিভাবক নিজেদের দোষারোপ করতে লাগলেন- আমরা কেনো সন্তানদের বুঝতে পারছি না? আমাদের সন্তানরাও কি ভেতরে ভেতরে এমন কষ্ট পাচ্ছে?
সর্বশেষ: চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডে আদালত মেনহাজকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে এবং উল্লেখ থাকে যে, ৪০ বছর কারাভোগের পূর্বে সে প্যারোলের জন্য আবেদন করতে পারবে না।
*** লেখাটি ‘উত্তর আমেরিকার চালচিত্র‘ (২য় খণ্ড) গ্রন্থ থেকে সংকলিত।