মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৯ পূর্বাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

২৩ জুলাই রাতের নির্মম ঘটনার বর্ণনা দিলেন তাসরিফ

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৪


ঢাকা, ১৬ আগস্ট – সম্প্রতি নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার তাসরিফ খান। বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) নিজের ফেসবুক পেজে ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।

নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তাসরিফ খান শুরুতে লেখেন, কিছু নির্মম ইতিহাস টাইমলাইনে থাকুক। তার স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

শুরুতে তাসরিফ খান লিখেন, ‘২৩ জুলাই রাত রাত ১টার কথা বলছি। একজন সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সার কল দিয়ে বললো, ‘তাসরিফ, তোর বাসার নিচে নাম, চা খাইতে আসতেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।’ ৫ জুলাই থেকে ছাত্রদের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট করা, কবিতা লিখতে থাকা এবং ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ গানটা ফেসবুকে চলতে থাকায় সরকারি গুন্ডা বাহিনীর থ্রেটে আমি তখন বাসার বাইরে অবস্থান করছিলাম। ওই সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সারের কথায় বিশ্বাস করে আমি তখন বাসার সামনে আসি উনার সঙ্গে দেখা করতে। গাড়ি থেকে ৬-৭ জনের মতো নেমে আসে। ইনফ্লুয়েন্সার সাহেব আমাকে একটু সাইডে নিয়ে আস্তে করে বুঝিয়ে বলে, ‘সঙ্গে যারা আছে তারা একটা এজেন্সির লোক এবং আইন প্রয়োগ সংস্থার বাহিনীর কয়েকজনও আছে এখানে।’ আমি তখন উনার কাছে জানতে চাই যে, উনারা কেন এসেছেন, কী চাচ্ছেন মূলত!

উনি তখন বুঝিয়ে বলেন, ‘সরকারি একটা কাজ আছে, এই সরকার আরও ৭-৮ বছর ক্ষমতায় থাকব। আমরা ঠিকমতো বাঁচতে চাইলে সরকারের পক্ষে কাজ করতে হইবো, এর বাইরে কোনো রাস্তা নেই।’ এ কথা বলে উনি আবার আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যান। সেই ৬-৭ জনের মধ্য থেকে একজন আমাকে বলে, ‘তাসরিফ, তোমাকে আমরা চিনি। আমরা তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দিতেছি, ছোট্ট একটা ভিডিও করতে হবে। এ ভিডিওটা আমাদের কালকের মধ্যে লাগবে। পরশু সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এই ভিডিওটা দেখবে এবং তারপর তুমি আপলোড করবা।’

সেই ইনফ্লুরেন্সার তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাকে বলে, ‘দেখ তাসরিফ, পিএমের চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ, ভিডিওটা ভালো করে কর, সরকার যতদিন আছে সুবিধা পাবি।’ কথা শেষ করার আগেই উনি পকেট থেকে এক লাখ টাকার তিনটা বান্ডেল, মোট তিন লাখ টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা সামান্য ছোট একটা গিফট! টাকা যত চাস, তত দেওয়া হবে, ভিডিওটা সুন্দর কইরা কর।’

ঠিক এ সময় আমার ফোনে আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তর নাম্বার থেকে একটা কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই শান্ত আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তাসরিফ! পাঁচ ছয়জন পুলিশ এবং সিভিল ড্রেসের কয়েকজন মিলিয়ে আমাকে রোল দিয়া সারা শরীরে মারছে!’ শান্তর কথা শুনে আমার হাত-পা একরকম কাঁপতে থাকে। আমি বোঝার চেষ্টা করি, এই মাইর খাওয়াটা কি আমাকে এদিকে রাজি করানোর জন্য ভয় দেখানো? নাকি শুধু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? শান্তর লাইন কেটে যায়।

আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয় দেওয়া তাদের বলি, ‘ভাই, এইমাত্র কয়েকজন মিলে আমার ভাই, আমার ব্র্যান্ডের ড্রামার শান্তকে প্রচুর মারছে!’ ওরা জাস্ট আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘আরেহ! দেশের যে অবস্থা, এটা এখন কিছু করা যাবে না। ওরে বলো বাসায় চলে যাইতে।’

আমার তখন মাথায় আসে, এখন যদি আমি ওদের টাকা ফেরাই দেই অথবা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাই, তবে তারা আমাকে চাইলেই গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে জোরপূর্বক আপলোড করাতে পারে। আমি তাই মাথা ঠাণ্ডা করে ওদের বলি ঠিক আছে আমি দেখতেছি কি করতে পারি, কালকের মধ্যে জানাচ্ছি। ওরা আমাকে তখনো একরকম থ্রেট দিয়ে বলে, ‘ভাই জানাচ্ছির সুযোগ নাই! সিচুয়েশন তো বুঝেনই। ভিডিও কালকেই লাগবে।’ সঙ্গে ওই ইনফ্লুয়েন্সারও আমাকে বলে, ‘তাসরিফ, ভিডিওটা তো পিএম দেখবে সো বুইঝা শুইনা সুন্দর কইরা করিস।’

ওদের সঙ্গে কথা শেষ করে আমি বাসায় ফেরত যাই। বাসায় সবাইকে সব সিচুয়েশন জানিয়ে আমি আমার ম্যানেজার আয়মান সাবিতকে ফোন দিয়ে বলি, ‘আয়মান, আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি, এই এই ঘটনা ঘটছে। আমি তোকে নাম্বার দিচ্ছি, তুই ওই এজেন্সিকে আমার বাসা থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে ওদের দিয়ে দিবি কালকেই। আমি আপাতত বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, কারণ আমি বাসায় থাকলে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।’

ওই সময় আমার মনের অবস্থা আমি জানি। আমার বাসার অবস্থা, ডায়াবেটিসের রোগী আমার আম্মুর অবস্থা, আব্বুর টেনশন, গুম হয়ে যাওয়ার চিন্তা এবং দেশের সঙ্গে বেইমানি করতে ওরা আমাকে বাধ্য করতে চাচ্ছে, সবকিছুই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সঙ্গে বারবার আমার কানে বাজছে শান্তর ওই কান্না ভরা আর্তনাদ।

কষ্টের ব্যাপার কি জানেন? এ ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে শান্ত আমাকে ফোন দিয়ে বলছিল, ‘খান, আমার বাসায় আম্মা নাই। এদিকে কারফিউ চলছে, দুপুরবেলা খাওয়া হয় নাই, একটা দোকানও খোলা নাই- আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগছে, কি করব?’ আমি শান্তকে বলছিলাম, ‘এক বড় ভাই ফোন দিছে, আমার বাসার সামনে যাওয়া লাগতেছে, তো তুমি আমার বাসায় চইলা আসো, দুই ভাই একসাথে খাব।’ ছেলেটা চাইছিল আমার বাসায় এসে ভাত খাইতে অথচ তাকে রাস্তায় বেধড়কভাবে মাইর খাইতে হইল। মার খাওয়ার পরে ফোনকলে ও আমাকে এটাও বলছিল যে, ‘খান! সবাই আমারে একসাথে রোল দিয়ে মারতেছিল আর একজন বন্দুক তাক করে চিল্লায়ে বলছিল, চুপচাপ মাইর খা অমুকের পোলা নাইলে গুলি কইরা মাইরা ফালামু, লাশ খুঁজে পাইব না তোর পরিবার!’

শান্ত এই কথাটা বলতে বলতে কাঁদতেছিল যে, ‘আমাকে ছাত্র বইলা বইলা ওরা মারছে আর বারবার বলতেছিল যে, এই অমুকের পোলা ছাত্র! ওরে মার!’ ওই রাতে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই।

আমি জানি কয়েকটা পোস্ট, কবিতা লেখা আর ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’-এর মতো কিছু গান করা ছাড়া দেশের জন্য তেমন কিছুই করতে পারি নাই। আমি জানি, আমি আবু সাঈদের মতো পথে গিয়ে বুক পেতে দিতে পারিনি। হয়তোবা এতটুকু সাহস আমার তখন হয়নি নাই। তবে, আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, আমি টাকার কাছে বিক্রি হয় নাই আর দেশের সাথে বেইমানি করি নাই।

এই পোস্ট, পোস্টে শান্তর ছবিগুলা এবং ওদের নির্মমতার কথাগুলো আমি লিখে পোস্ট করছি এই কারণে, যেন ভবিষ্যতে কখনো এই স্বৈরাচারের প্রতি আমার ঘৃণা এতটুকু পরিমাণও কমে না যায়।

আইএ/ ১৬ আগস্ট ২০২৪





আরো খবর: