রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

সংগ্রামী সাবেকুন নাহার পেলেন শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

সোয়েব সাঈদ,রামু::

শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারি নারী হিসেবে জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা পেলেন রামুর মেয়ে সাবেকুন নাহার। রবিবার (১৩ ফেব্রæয়ারি) দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে তাকে সম্মাননা হিসেবে ক্রেষ্ট, উত্তরীয় ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। এরআগে রামু উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হন সাবেকুন নাহার। পরে জেলা পর্যায়েও শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হলে বিভাগীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাবেকুন নাহার রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ারঘোনা গ্রামের মৃত মোহাম্মদ হোসেনের মেয়ে।
তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা গেছে- সাবেকুন নাহারের বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক। সাবেকুন এর মা তার বাবার ২য় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি সাবেকুন নাহারের মা কে বিয়ে করেন। বয়সের ভারে সাবেকুনের বাবা পরিশ্রমের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে সাবেকুনদের সংসার নির্মম দারিদ্রতায় ভুগতে থাকে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হত বাবাকে। সাবেকুন নাহার বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। তার এক ছোট ভাই সহ সাবেকুনদের চারজনের সংসার ছিলো আর্থিক দৈন্যতায় জর্জরিত। ফলে সাবেকুনের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ছাত্রী ভাল হওয়ায় উপবৃত্তি পেয়ে যাওয়াতে তার বাবা-মা তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে রাজি হন। অনেকগুলো তবে-হয়ত-কিন্তুর হুমকি কৌশলে এড়িয়ে চালাতে হয় সাবেকুনের পড়াশোনা। তারপরও ফি-বছর ভর্তির টাকা দিতে হয় বলে একসময় পড়াশোনা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয় পরিবার।
কিন্তু নাছোড়বান্দা সাবেকুন পড়াশোনা ছাড়তে নারাজ। তিনি পরীক্ষার সময় কাউকে কিছু না বলে স্কুলে গিয়ে হাজির হতেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে অফিস রুমে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। একটা সময় তারা যখন সাবেকুনকে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে দিতে রাজি হতেন ততক্ষণে অনেকটা সময় চলে যেত, সবার পরীক্ষা অনেকটা সময় হয়ে যেত। সাবেকুন পরের-দিন টাকা নিয়ে আসবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসতেন। কিন্তু পরেরদিন ও তিনি শূণ্যহাতে এসে হাজির হতেন।
এভাবেই একের পর এক শ্রেণি অতিক্রম করে সাবেকুন যখন এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবার দারপ্রান্তে, তখন পরীক্ষা শুরু হবার ঠিক দুদিন আগে সাবেকুনের বাবা স্ট্রোক করেন। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তার বাবা প্যারালাইজড হয়ে স্থায়ীভাবে শয্যাসায়ী হয়ে পড়েন। উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিও এখন থেকে পরনির্ভরশীল হয়ে উঠলেন।
উপায়ন্তর না দেখে সাবেকুন কে খুজে নিতে হল চাকরী। এসএসসি পরীক্ষার পর মাত্র ১৮০০ টাকা বেতনে শুরু করলেন তার সংগ্রাম। এসএসসি পাশ করলেও কলেজ ভর্তিটা তাই দিবাস্বপ্ন বোধ হল। আশার কথা হল ততদিনে সাবেকুন সংগ্রাম করতে শিখে গেছে। সাবেকুন টিউশনি করতে শুরু করল। স্বপ্নের পিছনে ছুটতে সব মিলিয়ে সংসার চালিয়ে সামান্য কিছু টাকা যেভাবেই হোক সঞ্চয় করতে হত তাকে।
এভাবেই পরের বছর কলেজে ভর্তি হয়ে যায় সাবেকুন। সেই সাথে আগের চাকরিতে খুব ভাল করায়, সুযোগ হয় আরেকটা চাকরির। ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত গণশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। সেটা করতে করতে সুযোগ চলে আসে আরেকটা ভাল চাকরীর। ভাল বেতনে নতুন চাকরিতে চলে আসেন সাবেকুন। পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে সাবেকুনের জীবন। সেই সাথে তার সংসারের ছোটখাট স্বপ্নগুলোও পুরন হতে থাকে। তার বাবা তখনও বেচে আছেন তার মেয়ের এ সাফল্য দেখবার জন্য। তার বাবা-মা আবার একটু করে হাসতে শিখেছেন। ছোট ভাইও স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ার সংশয় থেকে মুক্ত।
সুখের মুহুর্তগুলো কখনো আশংকামুক্ত থাকেনা। হঠাৎ করেই সাবেকুনের মা স্ট্রোক করে বসেন। কিন্তু এবার চিকিৎসার অভাবে বাবার মত তাকে প্যারালাইজড হতে হয়নি। সাবেকুন তার মায়ের সম্পূর্ণ চিকিৎসা সাফল্যের সাথে করতে সক্ষম হন। একজন প্রকৃত জয়ীতার মত জয় করেন ভাগ্যের নির্মমতা।
সাবেকুন নাহার সম্প্রতি কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রী পাস করেন। যে সংগ্রাম করে সে আজ জয়ীতা, সেই সংগ্রাম সেই অভীজ্ঞা তাকে বিচলিত হতে শিখায়নি। এমনটাই জানালেন- জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা সাবেকুন নাহার। বর্তমানে সাবেকুন নাহার বেসরকারি সংস্থা ইপসা’তে কর্মরত রয়েছেন। এরমধ্যে ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর বাবাকে হারান সাবেকুন নাহার। পরে ২০২১ সালের ২৮ মে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সাবেকুন। তাঁর স্বামী মো. আব্বাস উদ্দিন রামু হর্টি কালচার সেন্টারে কর্মরত রয়েছেন।
রবিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিভাগের দশটি জেলায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত জয়ীতা’দের সম্মাননা প্রদান করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন-মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন- মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচি ড. মুঃ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ও পরিচালক ফরিদা পারভীন। এছাড়া কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস – ২০২০ উদযাপন উপলক্ষে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমের আওতায় কক্সবাজার জেলা পর্যায়ে “শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী” ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হন সাবেকুন নাহার। বাংলাদেশ সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় এর উদ্যোগে এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ইতিপূর্বে সাবেকুন নাহারকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়।


আরো খবর: