বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৩ পূর্বাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

“উখিয়া হাসপাতাল আমাদের সবার, আসুন দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়”

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

উখিয়া স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগের চিত্র ও সামগ্রিক বিষয় নিয়ে লিখেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা: সাবরিনা নূর। তার লেখাটি হুবহু পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

“উখিয়া স্বাস্হ্য কমপ্লেক্স। জরুরী বিভাগ। যে কোন হাসপাতালের সবচেয়ে ব্যস্ততম জায়গা হল এই জরুরী বিভাগ। নামটাই যেন এই কাজের জায়গাটাকে পরিচয় করিয়ে দেয়।

এখানে দিন রাত সকাল বিকেলের কোন তারতম্য নেই। ছুটির দিনের অলস সকাল,গভীর রাত এমনকী ঈদের দিনটিতেও থাকে রাজ্যের ব্যস্ততা। সব হাসপাতালের মতন আমাদের উখিয়া স্বাস্হ্য কেন্দ্রেও আছে একটা জরুরী বিভাগ। বাংলার চেয়ে ইংরেজিটা নামটাই কেন যেন সবার বেশী পছন্দ। তাই একদম অজ পাড়া গাঁ থেকে আসা চাচাও বলেন ইমার্জেন্সি।

এখানে তিন শিফটের ডিউটিতে ডাক্তারের সঙ্গে থাকেন একজন স্বাস্হ্য সহকারী,একজন নার্স,আর একজন নিরাপত্তা প্রহরী। এখানে ছয়টা বিছানা আছে। খুব জরুরী রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কিছুক্ষন পর্যবেক্ষন করা হয়।এরপর অবস্হা বুঝে সিদ্ধান্ত। ভর্তি রাখা হবে নাকি পরবর্তী চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে পাঠানো হবে। এই সময়টাতে মাঝেমাঝে ঝামেলা হয়।

রোগীর অবস্হা ভাল না,আরো উন্নত চিকিৎসা লাগবে, আইসিইউ,সিসিইউ লাগবে,কিন্তু রোগীর লোক যেতে নারাজ। সেক্ষেত্রে অনেকসময় রিস্ক বন্ড নিয়ে রোগী রাখা হয়। অনেক সময় এমন হয় রোগী নীচের ওয়ার্ডে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই অবস্হা আরো খারাপ হয়ে গেছে। খুব খারাপ হলে হয়ত মারা গেছেন.. এবং এরপর শুরু হয় তুমুল গন্ডগোল। রিস্কবন্ডে সই দিয়ে জোর করে নিজ সিদ্ধান্তে রোগী রাখা মানুষগুলো পাগলের মতন আচরন শুরু করে।

অথচ ঘন্টাখানেক আগেই ঠিক এই ঘটনা ঘটতে পারার সম্ভাবনা জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।তবু মানুষের মনের মতন অযৌক্তিক আর কী আছে।আর যত দোষ সব যায় এতক্ষন সেবা দেওয়া মানুষগুলোর উপর। ডাক্তার নার্স ওয়ার্ডবয় কেউ বাদ যায়না। এমনকী মহিলা বলেও কেউ ছাড় পায় না। এরকম একটা দুটো টুকরো ঘটনা।
সময়ের সাথে সাথে শরীরের ক্ষত হয়ত শুকায়ে যায়
,কিন্তু যার সাথে হয় তার মনের ঘা কী আর এই জীবনে শুকায় ! স্বাস্হ্য সেবা মানেই কিন্তু জরুরী সেবা। যার অসুখ তার কাছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন সবচেয়ে জরুরী ।

এক্ষেত্রে চিকিৎসক কে মাঝেমাঝে ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। সবাই আসার সাথেসাথেই সেবা চান। অপেক্ষা ব্যাপারটা আমাদের কিছুটা স্বভাববিরুদ্ধ। মাঝেমাঝে একসাথে তিন চারজন জরুরী রোগী চলে আসেন।কারো বুকে ব্যাথা,কারো খেলতে গিয়ে হাত ভেঙেছে,এরমধ্যে এক দল চলে এসেছে মারামারি করে,কারো হয়ত মাথার ক্ষত থেকে তখনো রক্ত ঝড়ছে। ঠিক সেই সময়ে যখন জ্বরের রোগী নিয়ে কেউ আসেন অপেক্ষা করতে হবে সেটাই স্বাভাবিক।

একজন চিকিৎসক একই সাথে সবাইকে দেখতে পারবেননা। এটা আসলেই সম্ভব না। উনি তখন সবচেয়ে জরুরী যিনি সেই রোগীকে সবার আগে দেখবেন, এরপর একে একে বাকীদের । অনেকেই আছেন এইসব নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেন না। হাসপাতালে আসার সাথে সাথে সেবা না পেলে যাদের মাথা গরম হয় তাদের অনুরোধ করব আরেকবার ভাবুন। আমাদের কথা ভাবুন।

আমরা যারা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি আমরাও আপনাদের মতন। আমাদেরও ক্ষিধে পায়,ঘুম আসে, বাসায় রেখে আসা বাচ্চাটার কথা ভেবে মন খারাপ হয়। রোগী মারা গেলে আমাদেরও মাঝমাঝে ইচ্ছে করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে।

আপনাদের একটা খারাপ আচরন একজন ডাক্তারের ক্যারিয়ার থামিয়ে দিতে যথেষ্ট। ইদানিং কেউ কেন যেন দেশেই আর থাকতে চায়না। সেটা কী অনেক টাকা অথবা সুযোগসুবিধা পাওয়ার লোভে নাকি নিজের আর পরিবারের নিরাপত্তা আর সম্মানের খোঁজে।
সময় পেলে একটু ভেবে দেখবেন!

জরুরী বিভাগে আসা মাত্র রোগীর হাতের সুঁই ,স্যালাইন ,কিছু ইনজেকশন হাসপাতাল থেকেই দেয়া হয়। এছাড়া এখানে আছে ইসিজি মেশিন আর রক্তেরসুগার মাপার যন্ত্র । প্রয়োজন অনুযায়ী বিনামুল্যেই তা করা হয়। আর আছে ড্রেসিং এর একটা কর্নার। যেখানে কাঁটা ছেড়া সেলাই আর পুরানো রোগী ড্রেসিং করা হয়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় একশ রোগী এখানে সেবা নেন। যাদের অনেকেই ভাল হয়ে সুস্হ হয়ে বাসায় ফিরেন। খুব কম সংখ্যক রোগী কক্সবাজারে রেফার্ড হন। আরো কম সংখ্যক হয়ত হাজারে একজন মারা যান।
এই হাসপাতাল আমাদের সবার, আসুন আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়। তাহলেই বদলাবে জীবন.. বদলে যাবে দেশ।

পরিশেষে বলি, আমার দীর্ঘ এই ডাক্তার জীবনে রোগীদের এতএত ভালবাসা পেয়েছি, সবার কথা আলাদা করে হয়ত আজ মনেও নাই। কিন্তু একটা দুটো খারাপ ব্যবহার কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তবু ভালবাসা পেয়েছি বলেই হয়ত এখনো কাজ করার আগ্রহ পাই। ভাল মানুষ আছে। তাইতো এখনো সরকারী হাসপাতাল আর জরুরী বিভাগ গুলো টিকে আছে বছরের পর বছর ধরে।

আপনাদের সহযোগীতা আর ভালবাসা নিয়ে আমাদের এই পথচলা অব্যহত থাকুক—এই প্রত্যাশায় রইল ।”


আরো খবর: