প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে, টানা প্রবল বর্ষণ কিংবা ভূমিকম্প হলেই ভয়ংকর হয়ে উঠে কক্সবাজারের পাহাড়গুলো। চলতি মাসেও পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে ছয় জনের আর জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ১০ জনকে। পাহাড় ধসে মৃত্যুর জন্য মানুষের অসচেনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাই শনিবার (২৬ আগস্ট) কক্সবাজার সিটি কলেজ প্রাঙ্গণে পাহাড় ধসে মৃত্যু ঠেকাতে মানুষজনকে সচেতন করতে তিন ঘন্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ মহড়া। এতে অংশ নেন সিটি কলেজের বিএনসিসি প্লাটুন, রোভার স্কাউট, রেঞ্জার ইউনিট, যুব রেড ক্রিসেন্ট ও সিপিপি দুই শতাধিক কর্মী।
সরজমিনে দেখা যায়, বিশাল বিশাল পাহাড়, পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড় কেটে নির্মিত হয়েছে বসতি। এসব বসতিতে বসবাস করছে হতদরিদ্র মানুষজন। হঠাৎ মেঘ জমেছে আকাশে, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড়ের চারপাশে চলে নানা ধরনের কাজ-কর্ম। পাহাড়ে বসবাসকারী গৃহিণী করছে রান্নার কাজ আর একই সঙ্গে চলছে পাহাড় কাটা।
বেলা ১১টার দিকে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টিপাত সঙ্গে শুরু হয় বজ্রপাত। হঠাৎ উপড়ে পড়ছে গাছ, হচ্ছে পাহাড় ধস। পাহাড় ধসে বিধ্বস্ত বসতি, মাটি চাপা পড়েছে বসতির বাসিন্দারা। এরপর শুরু হয়েছে উদ্ধার তৎপরতা ও স্থানীয়রা খবর দেন ফায়ার সার্ভিসকে। এরই মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল লোকজনের আগমন এবং উৎসুক জনতার উদ্ধার কার্যক্রম বাধা প্রদান। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের টিম। শুরু হয় পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়া মানুষজনকে উদ্ধার কার্যক্রম। সিটি কলেজ প্রাঙ্গণে ‘বিশেষ মহড়া’ যা স্বচক্ষে দেখছেন স্থানীয় লোকজন ও শিক্ষার্থীরা।
স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, দুর্যোগ হচ্ছে দুই প্রকার। একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক ও অপরটি হচ্ছে মানব সৃষ্ট। কিন্তু কক্সবাজার পাহাড় ধসের ঘটনা হচ্ছে মানব সৃষ্ট। পাহাড় কাটার ভয়াবহতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম।
হুমায়ুন কবির নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, সমতলে জমি কেনার টাকা ছিল না। তাই পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড় কেটে বসতি করেছি। পাহাড়ের জমিগুলো দাম কম। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ মহড়া দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন পাহাড় কাটলাম, প্রকৃতিতে ধ্বংস করলাম। একদিন হয় তো পাহাড় কাটার মাশুল গুনতে হবে। আর পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভয়াবহ তা বিশেষ মহড়া থেকে দেখলাম।
বিশেষ মহড়া আয়োজনটি করেছে ফায়ার সার্ভিস। আর সার্বিক সহযোগিতা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল কক্সবাজার সিটি কলেজ এবং ইউএনডিপি। তারা জানালেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের সহযোগিতা করবেন তারা।
কক্সবাজারস্থ ইউএনডিপি’র হেড অব সাব অফিসের কর্মকর্তা কেইত সুগিমতো বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে ইউএনডিপি। এই প্রথম পাহাড় ধসের ভয়াবহতা দেখলাম আর এক সঙ্গে এই প্রথম উদ্ধার কাজ করলাম।’
কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং বলেন, পাহাড় ধসে ঝুঁকি কমাতে ফায়ার সার্ভিসের সচেতনতামূলক কার্যক্রম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পার্বত্য এলাকায় যারা বসবাস করে তারা পাহাড়ে থেকে অভ্যস্ত। পাহাড়কে কাটে না ও পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দেয়। কিন্তু কক্সবাজারে আমরা যারা আছি, আমাদের জায়গা কম বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসে জড়ো হয়। তারা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পাহাড় দখল করে তা কেটে বসতি নির্মাণ করে। যারা বসতি নির্মাণ করে তারা পাহাড়ে থেকে অভ্যস্ত না। পাহাড়কে কিভাবে রাখতে হবে তা ওরা জানে না। আমি মনে করি, এই বিশেষ মহড়ার মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হবে।
কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে বিরূপ আচরণ করা মানুষ আজ প্রকৃতির বিরূপ আচরণের শিকার হচ্ছে। তাই সচেতনতামূলক এই মহড়া মানুষকে সচেতন করবে। আর প্রকৃতির ওপর বিরূপ আচরণ না করে প্রকৃতিকে রক্ষায় সকলকে উদ্যোগী হতে হবে বলেও জানান তিনি।
আর পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে বিশেষ মহড়ার আয়োজন বলে জানালেন ফায়ার সার্ভিস।
কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক অতীশ চাকমা বলেন, মূলত পাহাড়ের পাদদেশে যারা বসবাস করে এবং পাহাড় কেটে যারা পাহাড়কে নষ্ট করছে তাদেরকে সচেতন করার জন্য আমাদের এই আয়োজন। ভারি বৃষ্টিপাত ও ভূমিকম্পে পাহাড় ধস হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা বেশি হয়ে যায়। তাই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা কমানোর জন্য জনগণকে সচেতন করছি।