সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫, ০৮:৩৮ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

সিলেটি বনাম বেঙ্গলি – DesheBideshe

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫




পরিচয়—এই শব্দটি কখনও অহংকার, কখনও গর্ব, আবার কখনও বিভ্রান্তির নাম। আমরা কে? কই থেকে এসেছি? এবং কাদের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দেখি? ‘সিলেটি না বেঙ্গলি’ প্রশ্নটি কেবল ভাষা বা অঞ্চল নয়—এটি বহুস্তর জিজ্ঞাসার দরজা খোলে।

সম্প্রতি আমার এক পরিচিত ব্যক্তি একটি বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার প্রশ্ন- সিলেট অঞ্চলের অধিবাসীরা তাদের এলাকার বাইরের লোকদের ‘বেঙ্গলি’ বলে থাকেন। তিনি জানতে চান সিলেটিরা কী বেঙ্গলি নন?

এ প্রশ্ন শুধু কানাডায় নয়। মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপেও শুনেছি। একবার এক পরিচিত মহিলার সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করলাম- ’আপনাদের বিল্ডিং-এ কী আর কোনো বাঙালি থাকে? তিনি বললেন না ভাই, তবে কয়েকটা সিলেটি ফ্যামিলি থাকে।’ আরেকবার একজন একটি সংগঠন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘এই অ্যাসোসিয়েশনে সব বেঙলি, কোনো সিলেটি নেই।’ আসলে এটা কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে নয়; কিংবা কোনো বিভেদ থেকেও নয়; এটা একধরনের সরল উক্তি।

কেন সিলেটিরা অন্যান্য এলাকার লোকজনদের ‘বেঙ্গলি’ বলে! জেনে নিন এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।

বৃহত্তর সিলেট—শ্রীহট্ট—সিলেট শুধু একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়—এটি এক বিস্ময়কর ঐতিহ্যের আধার, আধ্যাত্মিক আলোয় উদ্ভাসিত এক জনপদ। এই অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম, সংস্কৃতি, জ্ঞান ও কাব্যের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত।

সিলেট একসময় ছিল বাংলার অংশ, পরে ব্রিটিশ আমলে তা আসামে যুক্ত হয়। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশরা আসামের শাসনভার গ্রহণ করলে সিলেটকে এর অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকালে আসামকে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিলে সিলেট আবার বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু ১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে তা আবার আসামে ফেরত যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় গণভোটে সিলেটের একটি অংশ (আজকের সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ) পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়, আর অপর অংশ (করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, বরাক) থেকে যায় ভারতে। এই বিভাজন রাজনৈতিক হলেও সিলেটের আত্মিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐক্য ছিন্ন হয়নি।

সিলেট মানে কুয়াশা ঢাকা সকালের চা-বাগান, সুনীল পাহাড় আর বয়ে চলা নদীর সঙ্গীত। খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা এই ভূমি যেন এক কাব্যিক ভূগোল। বরাক, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, জাদুকাটা—এসব নদী শুধু জল নয়, বহন করে ইতিহাস আর কালের ধ্বনি।

১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সিলেট এলেন, তখন এটি ছিল আসামের অন্তর্ভুক্ত। তিনি ব্যথিত হয়ে লিখেছিলেন: “বাংলার প্রান্তসীমা হতে নির্বাসিতা তুমি, সুন্দরী শ্রীভূমি!” এই একটি পঙক্তিতেই ধরা পড়ে সিলেটের আত্মপরিচয়ের দহন।

এই মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন থেকেই সিলেটিরা নিজেদের ‘বেঙ্গলি’ না বলে ‘সিলেটি’ বলে পরিচিত করতে অভ্যস্ত হন। যদিও বাস্তবিক অর্থে তারা বাংলারই সন্তান। কিন্তু ইতিহাসের দোলাচলে তাঁরা নিজেরাই তাঁদের নাম আলাদা রেখেছেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সিলেট থেকেই—এ তথ্য অনেকের কাছেই অজানা। ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ—সেদিন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আয়োজিত একটি ছাত্র সমাবেশ থেকে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়। সিলেটের মানুষ তখনই রাস্তায় নামে, মিছিল করে, সভা করে। সিলেট শহর হয়ে ওঠে বাংলার দাবিতে বিক্ষোভের প্রধান ক্ষেত্র। বহু স্থানে পুলিশের লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার, এমনকি গুলি বর্ষণের ঘটনাও ঘটে। ভাষা আন্দোলনের পূর্বপ্রস্তুতি, মাটি ও আগুন তৈরি হয়েছিল এই শ্রীভূমিতে।

এদিকে ১৯৬১ সালের ১৯মে আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ১১ জন শহিদ হন। এঁরা সবাই ছিলেন সিলেটি। আজও বরাক উপত্যকার মানুষ শ্রদ্ধাভরে তাদের উচ্চারণ করেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চল ছিল অন্যতম প্রধান ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিলেটের বীর সন্তান জেনারেল এম এ জি ওসমানি।

মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উপ-প্রধান এবং স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী অন্যতম নেতা ছিলেন জেনারেল এম এ রব। এছাড়া অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ তাদের সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

সিলেটের মানুষের আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও সংগঠনের কারণে মুক্তিযুদ্ধ আরও দৃঢ় এবং গতিশীল হয়ে উঠেছিল। এ অঞ্চল শুধু মুক্তিযুদ্ধের একটি অধ্যায় নয়—একটি সাহসিকতার প্রতীক।

সিলেটি ভাষার নিজস্ব একটি লিপি ছিল—‘সিলেটি নাগরি’। এতে ইসলামী সাহিত্য, লোকজ কাব্য, আধ্যাত্মিক গান, প্রবাদ ও উপদেশ লেখা হতো। উনিশ শতকে এই লিপিতে ছাপা হতো বই, চটি, ধর্মগ্রন্থ।

যদিও ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার চাপ, নবজাগরণের ঢেউ, আর আধুনিক বাংলা লিপির প্রসারে সিলেটি নাগরি লুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ে, তবুও এটি এক গৌরবোজ্জ্বল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। আজও কেউ কেউ এই লিপিকে নিয়ে গবেষণা করছেন, ডিজিটাল ফন্ট বানাচ্ছেন, সংগ্রহশালা গড়ে তুলছেন।

উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে — সিলেটি ভাষাভাষী মানুষ কেবল আসাম বা সিলেট অঞ্চলে বসবাস করে না। ত্রিপুরা, মেঘালয়, মনিপুর, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও শত শত বছর ধরে সিলেটিরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। প্রতি বছর কলকাতায় মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয় সিলেট উৎসব। এছাড়া শিলচর, দিল্লি, মুম্বাইতেও আয়োজন করা হয় সিলেটিদের মিলন মেলা। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আয়োজন করা হয় বিশ্ব সিলেট সম্মেলন।

প্রবাসে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় সিলেট অঞ্চলের লোকজন বরাবরই বেশি। তবে এটি নিছক সংখ্যা নয়—এ এক ইতিহাস, এক অভিযাত্রার গল্প। যখন বৃহৎ বঙ্গের মানুষজন ছিল ঘরকুনো জীবনে অভ্যস্ত, তখনই সিলেটিদের চোখে ভেসে উঠেছিল দূর দিগন্তের ডাক। তারা ঘর ছাড়েন জীবিকার টানে, কিন্তু নিয়ে যান হৃদয়ের সংস্কৃতি, ভাষা আর পরিচয়ের বাতি। সিলেটিরা প্রবাসে শুধু শ্রমিক হয়ে থাকেননি—তারা হয়েছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধা, উদ্যোক্তা, সংস্কৃতির বাহক এবং বাংলার পরিচয়ের দূত। বলা চলে, বিদেশ যাত্রার পথরেখায় সিলেটিরাই পথপ্রদর্শক।

‘সিলেটি না বেঙ্গলি’ প্রশ্নটি আসলে কৃত্রিম বিভেদ। বাস্তবে আমরা সবাই একই নদীর স্রোতধারা—কেউ উজানে, কেউ ভাটিতে। সিলেটিরা যেমন বাঙালির অংশ, তেমনি বাঙালি পরিচয়ের ভেতরেও সিলেটিদের স্বাতন্ত্র্য আছে। এ বিভিন্নতাই আমাদের ঐতিহ্যকে করে সমৃদ্ধ। আমরা সবাই এক ইতিহাসের সন্তান, এক কাব্যের উপাখ্যান।



আরো খবর: