শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০০ পূর্বাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

‌র‍্যাবের অভিযানে আরসার শীর্ষ কমান্ডার নুর মোহাম্মদসহ আটক ৬ : বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: শনিবার, ২২ জুলাই, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক:-
কক্সবাজারের টেকনাফের গহীন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) শীর্ষ কমান্ডার নুর মোহাম্মদকে আটক করেছে র‍্যাব-১৫। এসময় একই সংগঠনের আরো পাঁচ সন্ত্রাসীকে আটক করা হয় এবং উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমান অস্ত্র।

শনিবার (২২ জুলাই) সকালে কক্সবাজার র‍্যাব ১৫ এর সদর দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য নিশ্চিত করেন, র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল সাইফুল ইসলাম সুমন পিএসসি জানান, কক্সবাজারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের শরণার্থী শিবির ও পাশ্ববর্তী এলাকাসমূহে খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক,মানবপাচার, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্রিক কোন্দলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপ আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, শরণার্থী শিবির ও এর সংলগ্ন গহীন পার্বত্য এলাকাসমূহে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা)’সহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এ সকল খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করছে; যার কারণে শরণার্থী শিবিরের সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় এলাকাবাসীকে সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও পাশ্ববর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি আলোচিত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। উক্ত ঘটনাসমূহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। র‌্যাব এ সকল সন্ত্রাসী গ্রুপ শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

শুক্রবার (২১ জুলাই) রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১৫ এর একটি আভিযানিক দল কক্সবাজারের টেকনাফ থানাধীন বাহারছড়া-শামলাপুরের গহীন পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এর অন্যতম সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদ (২৮) কে আটক করেন। সে উখিয়া ৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি/১৭ ব্লকের মৃত দিল মোহাম্মদের ছেলে। তার বিরুদ্ধে এক ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে বলে র‍্যাব জানায়। পরবর্তীতে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাহারছড়া ও শামলাপুরের বিভিন্ন এলাকা হতে আরসা’র অন্যান্য সন্ত্রাসী ধলা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হোসেন জোহার (৩০), ওবায়দুর রহমানের ছেলে মোঃ ফারুক (প্রকাশ হারেস) (২৩), জেবর মল্লুকের ছেলে মনির আহাম্মদ (৩৬), অলি আহাম্মদের ছেলে নূর ইসলাম (২৯) এবং হোসেনের ছেলে মোঃ ইয়াছিন (২১) কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

আটককৃত সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ১টি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, ১টি বিদেশী রিভলবার, ১টি শর্টগান, ৪টি দেশীয় এলজি, ৩টি দেশীয় রামদা ও গোলাবরুদসহ নগদ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত সন্ত্রাসীদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক এবং পাশ্ববর্তী দেশের সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এর তারা জড়িত এবং শীর্ষ নেতা ও সক্রিয় সদস্য। গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মোহাম্মদ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প অন্যতম এর সামরিক কমান্ডার হিসেবে আরসা’র নেতৃত্ব প্রদান করেন । তার নেতৃত্বে আরসা’র ৩০-৩৫ জন সদস্য কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প ও তার পাশ্ববর্তী এলাকা সমূহে খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, মানবপাচার, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য তারা পাশ্ববর্তী দেশ হতে দূর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করে থাকেন।

গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মোহাম্মদ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে শরণার্থী শিবির ও স্থানীয় জনগণের নিকট হতে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করতো। চাঁদার অর্থ না পেলে ভিকটিমকে অপহরণপূর্বক শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনসহ মুক্তিপণ আদায় করত। মুক্তিপণ না পেলে তারা ভিকটিমকে খুন করে গহীন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করতো বলে তারা জানান ।

সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরণের মাদক বাংলাদেশে পরিবহণ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও সংলগ্ন এলাকাসমূহে সংরক্ষণের কাজে মাদক ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট চাঁদার বিনিময়ে এই সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যরা সহযোগিতা করতো । তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম শেষে পাহাড়ী গহীন জঙ্গলে আত্মগোপনে চলে যেত। তাদের অত্যাচারে শরণার্থী শিবিরের শরণার্থীরা সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তারা তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করতো বা অপহরণের পর লাশ গুম করতো বলে জানা যায়। তারা বেশ কয়েকদিন ধরে আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে টেকনাফ থানাধীন শামলাপুরে অবস্থান করছিল বলে জানান।

গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মোহাম্মদ (২৯) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। তিনি ২০১৬ সালে সে‘আরসা’ সদস্য আরিফ উদ্দিনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন‘আরসা’ এ যোগ দেয়। পরবর্তীতে সে সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব পায়। আরসার সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের সাথে তার বিশেষ সখ্যতা ও নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। সে কুংফুতে ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত ও বিস্ফোরক তৈরীতে পারদর্শী ছিল। সে আরসা’র অন্যান্য সদস্যদের কুংফু প্রশিক্ষণ দিত। সে আরসা’র সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের কাছ থেকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ ও আরসা’র মূল সংগঠক আরিফ উদ্দিন (হাসেম) কুইল্লা এর কাছ থেকে বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ নেন।

সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প-৮ এ অবস্থান করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে সে ক্যাম্প-৮ এ আরসার হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পায়। পরবর্তীতে তার নেতৃত্বেই কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এর আরসার সদস্যরা খুন, টার্গেট কিলিং, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা শুরু করে। সে হেড মাঝি শফি উল্লাহ, সালাম, সলিম, মালেক, হাবুইয়া, ইমান, আবুল মুনসুর, সালেহ হত্যাকান্ডসহ, জোরপূর্বক একজন মহিলার ঘরে প্রবেশের সময় মহিলা বাধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যাকান্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ৬ জন হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত ছিল।

সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা’র জন্য চাঁদা সংগ্রহ এবং আরসা’র শীর্ষ নেতাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত অর্থ ক্যাম্পের জিম্মাদারদের মাঝে বণ্টন করত। এছাড়াও ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের মাদক বিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন।

উক্ত সন্ত্রাসী হামলায় একজন র‌্যাব সদস্য গুরুত্বর আহত হন। উক্ত হত্যাকান্ডের সাথে সে সরাসরি জড়িত ছিল এবং ঘটনাস্থলে নিজে উপস্থিত থেকে উক্ত কর্মকর্তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন বলে তিনি জানায়। বিভিন্ন সময়ে অপহরণ, টার্গেট কিলিং শেষে কক্সবাজারের গহীন পার্বত্য এলাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকতো বলে জানায়। তার বিরুদ্ধে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি থানাসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫ এর অধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।

গ্রেফতারকৃত মোঃ হোসেন উরফে জোহার (৩০) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। সে ২০১৬ সালে আরিফ উদ্দিন উরফে হাসেমের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরসায় যোগ দেয়। আরসায় যোগদানের পর সে অস্ত্র চালনা, কুংফু ও রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ লাভ করে। সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশপূর্বক শরণার্থী ক্যাম্প-১৫ এ অবস্থান করে। পরবর্তীতে ক্যাম্প-১৫ এ আরসা’র হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পায়। বিভিন্ন সময়ে হাফেজ নূর মোহাম্মদ ও মাস্টার সলিম এর নির্দেশনায় তার নেতৃত্বে টার্গেট কিলিং, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং মুক্তিপণ না পেলে হত্যাপূর্বক লাশ গুম করা হতো। এছাড়াও, সে শরণার্থী শিবিরে হেডমাঝি আবু তালেবকে গুলি করে হত্যা, সাবমাঝি সৈয়দ হোছেনকে গুলি করে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা ও শফিকুর রহমানকে গুলি করে হত্যার প্রধান সহযোগী হিসেবে জড়িত ছিল বলে জানা যায়।

গ্রেফতারকৃত ফারুক উরফে হারেস (২৩) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং শরণার্থী হিসেবে শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প-১৫ এ অবস্থান করতো। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে মাস্টার সলিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড তার আপন বড়ভাই মোঃ শাহ আলম এর মাধ্যমে আরসায় যোগ দেয়। সে ক্যাম্প-১৫ এর আরসা’র প্রহরী দলের প্রধান সমন্বয়কারী এবং ‘টর্চার সেল’ এর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। তার ৭-৮ জনের একটি নেট গ্রুপ রয়েছে যারা নিয়মিত ক্যাম্পের প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতো এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের নিকট রিপোর্ট প্রদান করতো। এছাড়াও, সে নিয়মিত স্থানীয় দোকানপাট হতে মাসিক চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

এছাড়াও গ্রেফতারকৃত মনির আহাম্মদ (৩৬), নূর ইসলাম (২৯) এবং ইয়াছিন (২১) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। তারা ২০১৬ সালে আরসা’র সন্ত্রাসী গ্রুপে যোগদান করে। আরসায় যোগদানের পর তারা মায়ানমারের অভ্যন্তরে অস্ত্র চালনার উপর প্রশিক্ষণ লাভ করে। পরবর্তীতে তারা ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং শরণার্থী হিসেবে শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প-১৬ এ অবস্থান করতো। তারা সকলেই মোঃ হোসেন ওরফে জোহার এর অধিনস্থ ১০-১২ জনের সন্ত্রাসী দলের সদস্য। বিভিন্ন সময়ে তারা স্থানীয় দোকানপাট হতে মাসিক চাঁদা উত্তোলন, অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায়, মুক্তিপণ না পেলে লাশ গুমসহ অন্যান্য অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল বলে জানা যায়। এছাড়াও তারা পাহাড়ে অবস্থিত গোপন আরসা ঘাঁটির নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতো বলে জানা যায়।

কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সহ-অধিনায়ক মেজর সৈয়দ সাদিকুল ইসলাম পিএসসি বলেন, অপরাধীচক্র যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে র‌্যাব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে।

গ্রেফতারকৃত আরসা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।


আরো খবর: