করোনাভাইরাস মহামারির সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন এক যুদ্ধের সামনে দাঁড়াতে হলো বিশ্বকে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেই যুদ্ধ আজ দ্বিতীয় বছরে গড়িয়েছে। ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলার নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই দেশ হারিয়েছে লাখো সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম। লড়াই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ইউক্রেনের হয়ে পরোক্ষভাবে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের মিত্র দেশগুলো। মস্কোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। এমন বাস্তবতায় পুরো বিশ্বে পড়ছে যুদ্ধের প্রভাব।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে বিশ্বের সম্মিলিত বিবেকের জন্য ‘অপমান’ কড়া নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, এটি জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এই হামলা আমাদের সম্মিলিত বিবেকের অবমাননা। এটি জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
জাতিসংঘ বলছে, ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে অন্তত ৭ হাজার ১৯৯ জন বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন হাজার হাজার। সংখ্যাটি অনেক বেশি হতে পারে।
কার নিয়ন্ত্রণে কোন অঞ্চল?
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলার শুরুতে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের বেশ কিছু জায়গা নিয়ন্ত্রণে নেয় রাশিয়া। কিয়েভ ও খারকিভে আক্রমণ করলেও ব্যর্থ হয় রুশদের। শুরুতে খেরসন দখলে নিলেও পরবর্তীতে ধরে রাখতে পারেনি মস্কো। ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি পূর্ব ইউক্রেনের বাখমুত এবং আশেপাশে কৌশলগত বিজয় লাভ করেছে মস্কো। যদিও শহরটি নিয়ন্ত্রণ রাখতে লড়ছে ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা।
দক্ষিণাঞ্চলের খেরসনের প্রাদেশিক রাজধানী কিয়েভ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলেও ডনিপ্রো নদীর পূর্ব দিক রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। সময় যত গড়াচ্ছে, ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের প্রতিরোধ এবং পাল্টা হামলা ততই বাড়ছে। ফলে প্রতিনিয়ত পিছু হটছে মস্কো।
কোথায় আশ্রয় নিয়েছে ইউক্রেনীয়রা?
হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে লাখ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে। সবশেষ তথ্যে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ পোল্যান্ডে। এছাড়া রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশে শরণার্থী হিসেবে জায়গায় হয়েছে ইউক্রেনীয়দের।
ন্যাটোর ভূমিকা
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক জোট ন্যাটো। প্রেসিডেন্ট পুতিনের হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত না হলেও কিয়েভকে অস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করে আসছে ন্যাটো।
সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বে তালিকার পঞ্চম অবস্থানে রাশিয়া। এই যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার ৯ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য ছিল। আর ইউক্রেনের ছিল ২ লাখ ৯ হাজার।
এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস দাবি করেছেন, ১২ মাসে ইউক্রেনের মাটিতে ১ লাখ ৮৮ হাজার সেনা হারিয়েছে রাশিয়া।
গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে তিনি বলেন, ট্যাংক, ইরানি ড্রোন, হেলিকপ্টার হারিয়ে নজিরবিহীন বিপর্যয়ের মুখে মস্কো। তবে ইউক্রেনের কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এ নিয়ে মুখ খোলেনি কিয়েভ।
জিতছে কে?
রাশিয়া শুরুতে কিয়েভসহ পুরো ইউক্রেন দখল করতে চেয়েছিল। তার ব্যর্থ হয়ে নতুন লক্ষ্য ডনবাস অঞ্চল দখল করায় মনোযোগী হয়। ইউক্রেন চায় ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়াসহ সব ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে রুশ সেনাদের তাড়িয়ে দিতে। এক বছর পার হলেও রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। অনেকেই বলছেন, যুদ্ধে কারা জয়ী তা মূল্যায়নের সময় আসেনি।
মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ার জেনারেল মার্ক মিলি কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, এই যুদ্ধে রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই নিজেদের লক্ষ্য সামরিক উপায়ে অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে।
সমাধান কোন পথে?
যুদ্ধ বন্ধ অবসানের কার্যকর আলোচনায় বসছে না দুই দেশ। এর মধ্যেই ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ মিত্র দেশগুলো। দীর্ঘদিন ধরে সামরিক ও মানবিক সহায়তায় দিয়ে আসায় অস্ত্রের মজুত ফুরিয়ে আসছে ইউরোপের। যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্রুত কোনও সমাধানে না পৌঁছানো গেলে ভুগতে হবে সবাইকে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান শুরুর দিকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার পর কয়েক দফা আলোচনা হলেও সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। এবার যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে শান্তি প্রস্তাব হাজির করতে পারে চীন। তবে ইউক্রেন ও রাশিয়া নিজেদের লক্ষ্য অর্জন থেকে পিছু হটার কোনও ইঙ্গিত না দেওয়ায় চলতি বছরের সংঘাত আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি