ঢাকা, ০৫ ডিসেম্বর – বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনামলে কেবল বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা থেকেই ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে।
তবে অন্যান্য অর্থনীতিবিদের হিসাবে এর পরিমাণ আরও বেশি। তাদের মতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি হতে পারে।
যদিও পাচার হওয়া অর্থের প্রকৃত পরিমাণ কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
বিভিন্ন ধরনের আর্থিক হিসাব-নিকাশ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে তার সহযোগীরা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট করেছেন, তা কার্যত পৃথিবীর আর্থিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
বুধবার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি–বিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে সার্বিকভাবে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।
তার ভাষ্য, বিশ্বের অন্য কোনো দেশে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এভাবে গুন্ডা–মাস্তানদের সহযোগিতায় পুরো ব্যাংক খাতে এমন পদ্ধতিগতভাবে ডাকাতি করেছে, এমন ঘটনা তিনি আর কোথাও দেখেননি।
বাংলাদেশের আগামীর অর্থনীতি প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগামী বছর অর্থনীতির আকাশে আরো ঝড় উঠবে; এরপর অর্থনীতির আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করেন। তার ভাগ্যে কী আছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে এখনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি।
তবে আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ‘উইচ হান্ট’ করা হচ্ছে, তিনিও তার বাইরে নন।
হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএফআইইউর নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান। ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এস আলম গোষ্ঠীর হাতে যাওয়ার পর নামে–বেনামে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যে ঋণের বড় অংশ আর ফেরত আসেনি। ফলে সেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে।
এদিকে এস আলম গ্রুপও বসে নেই। তারা আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন ইমানুয়েলের মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, দেশের একটি মাত্র ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সেটা ইসলামী ব্যাংক নয়। তাদের অভিযোগ, আহসান এইচ মনসুর এস আলম গোষ্ঠীর সঙ্গে নিপীড়নমূলক আচরণ করছেন; এমনকি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।
লাইফ সাপোর্টে ব্যাংক খাত
বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক এখন লাইফ সাপোর্টে আছে বলে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি যেসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারাও সেভাবে ঋণ দিতে পারছে না, এমনকি আমানতকারীদের টাকা সব সময় ফেরত দিতে পারছে না। আমানতকারীদের তারা মাঝেমধ্যে টাকা তোলার সুযোগ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে যে টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শেখ হাসিনার দলের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা করা হয়েছে, যে অর্থ মূলত আমদানি–রফতানির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে যে কেবল কিছু মানুষের পকেট ভারি হয়েছে তা নয়, এতে বাংলাদেশের মুদ্রার দরপতনও হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশ থেকে এই অর্থ পাচারের গতি বাড়তে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের মুদ্রার বড় ধরনের দরপতন হয়। আমদানি মূল্য অনেকটা বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের লোডশেডিংয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশ।
অনেক ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পুরো বেতন তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমনকি যেদিন বেতন দেওয়া হয়, সেদিন তারা পুরো টাকা তুলতে পারেননি, এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।
ওষুধ কোম্পানি টেকনো ড্রাগ কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এই কোম্পানির সহমহাব্যবস্থাপক মাজেদুল করিম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, নিম্ন আয়ের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কর্মীরা তার কাছে অভিযোগ করেছেন, ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না, সে কারণে কোম্পানি বাধ্য হয়ে নগদ অর্থে মজুরি পরিশোধ করছে।
তিনি আরো বলেন, নিজের ডেবিট কার্ড দিয়েও টাকা তোলা যাচ্ছে না।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বছর নয়, যদিও মূল্যস্ফীতির হার কমে আসছে ও প্রবাসী আয়প্রবাহ বাড়ছে। তিনি আশাবাদী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশের মুদ্রা স্থিতিশীল করতে আরো তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা দেবে। ভবিষ্যৎ নিয়েও যথেস্ট আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস