শিরোনাম ::
রাজশাহীকে ৮০ রানে গুটিয়ে বিশাল জয় চিটাগংয়ের টেকনাফে ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় আসামী হলেন বড় ভাইসহ ৪ জন : মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন উলিপুরে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি মতি শিউলি আটক মহেশখালীতে পুলিশের অভিযান সাজাপ্রাপ্ত আসামীসহ গ্রেপ্তার ৪ মানবপাচারে গ্যাংস্টার-পুলিশের ভয়ানক জাল, জড়িত উখিয়া-টেকনাফের পাচারকারী মিয়ানমারের আরাকান আর্মি আটকে রাখা দু’টি জাহাজ টেকনাফ স্থলবন্দরে নোঙর টেকনাফে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রের মৃত্যু যা করলে সহজেই কাছে আসবে মেয়েরা! সাইফ আলি খানের ওপর হামলা চালানো যুবক বাংলাদেশি এবার দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার আনিসুল হক
সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৫৬ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

মানবপাচারে গ্যাংস্টার-পুলিশের ভয়ানক জাল, জড়িত উখিয়া-টেকনাফের পাচারকারী

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৫

মা, এত কষ্ট জানলে বাড়ি থেকে বের হতাম না। মৃত্যু যে কোনো সময় হবে, সেটি জেনেই প্রতিদিনই বের হই। শুধু আপনাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই বিদেশের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছি…। মা, পাহাড় সমান কষ্ট করে অবশেষে মালয়েশিয়ায়। কিন্তু এখানে এক গ্যাংস্টার আটকে রেখেছে। এক মাস কোনো আলো-বাতাসের স্পর্শ নেই। হাত-পা ও মুখ বেঁধে রেখেছে। টাকা চাচ্ছে…।

বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে যাওয়া ২০ বছর বয়সী তরুণ বাকিবিল্লাহর কথা এসব। তার বাড়ি কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর কালারমারছড়া এলাকায়। তিনি তার মা দিলদার বেগমকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কান্না করে এসব ভয়েস দেন তিনি। যিনি চলতি বছরের ৩০ জুলাই অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যান। যাওয়ার পথে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে পরতে হয় তাকে। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে ভারতের কলকাতা। সেখান থেকে ১৫ দিনের জার্নি। ভিয়েতনাম, জঙ্গল পথে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড তারপর মালয়েশিয়া। কাহিনি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু মালয়েশিয়া গিয়ে ভয়ংকর গ্যাংস্টারের কবলে পরেন তিনি।

১৫ দিনের ধকল কাটিয়ে মালয়েশিয়ায় পা রাখার পরপরই, ‘রনি মজুমদার’ নামের এক গ্যাংস্টার একটি আবদ্ধ ঘরে আটকে রাখে ৩০ দিন। আলো-বাতাসহীন এইসব ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে বাকিবিল্লাহসহ আরো ১৫ জনকে আটকে রাখা হয়। টাকার জন্য হাত-পা ও চোখ বেঁধে শারীরিক মানসিক অত্যাচার করা হয়। প্রতিজন ৪ লাখ টাকা কন্ট্রাক করার পরও আরো টাকার জন্য নির্মম অত্যাচার চালায় তারা। পরে প্রত্যেকে পরিবারের কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে বার্তা পাঠান বাংলাদেশের এজেন্টদের টাকা দিতে। টাকা দেওয়ার পর তারা সবাই মুক্তি পান।

বাংলাদেশ থেকে কীভাবে মানব পাচার করা হয়, কারা এসবে জড়িত-এসব বিষয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছে আমার দেশের এই প্রতিবেদক। মানবপাচারে জড়িত প্রমাণ পাওয়া গেছে স্বয়ং পুলিশকে। পুলিশের বিশেষ শাখা ডিবির ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরী সরাসরি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক দুটি গ্যাংস্টার, দেশের এক কুখ্যাত মানবপাচারকারী ও বেশ কয়েকটি এজেন্সির সঙ্গে।

আন্তর্জাতিক দুটি গ্যাংস্টার হলো- মালয়েশিয়া ভিত্তিক রনি মজুমদার ও এএসপি কোম্পানি। দেশের কুখ্যাত এক পাচারকারী হলেন কক্সবাবাজের টেকনাফ থানার মো. সোহাগ ও সাগর। দেশের দুই এজেন্সি হলো-ঢাকার পল্টন থানা এলাকার নীলনদ ওভারসিজ, গুলশান সিটি সেন্টারের পাশে ‘বস রমজান’। এগুলো চালান মূলত চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশেরই বেশ কিছু সদস্য। সোহাগ ও সাগরকে লোক এনে দেয়ার কাজে সহায়তা করেন টেকনাফের উখিয়া থানার আনোয়ার হোসেন, সোহাগের বড় ভাই নুরুল ও আত্মীয় নুরুল হক।

দীর্ঘ অনুসন্ধানে চট্টগ্রামের অন্তত ৫০ পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরমধ্যে রয়েছেন বাঁশখালীর ৫ জন, চকরিয়ার ৪ জন, পেকুয়ার ৫ জন, মহেশখালীর ৬ জন, টেকনাফের ৫ জন, কক্সবাজার সদর এলাকার ১০ জন, বাঁশখালীর ৮ জন, কুতুবদিয়ার ৯ জনসহ মোট ৫০ জন। তাদের বিদেশ নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই চক্রটি। টাকা লেনদেনের কাগজপত্র এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ বছরে অন্তত এক হাজারের বেশি মানুষ এদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। টাকা দিয়ে বিদেশ যেতে না পারলেও, মেরে ফেলার ভয় দেখানোর ফলে এতদিন তারা মুখ খুলেননি। কারণ এই চক্রের পেছনে বেকআপ হিসেবে ছিলেন পুলিশই। এই প্রতিবেদক ৫০ জনের মধ্যে ১১ জনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে। এরমধ্যে ৯ জন এখনো দেশে। বাকি দুজন থেকে আরও টাকা নিয়ে অবৈধ পথে মালিয়েশিয়ায় নিয়ে গেছে চক্রটি।

ad
যেভাবে প্রতারণার শিকার ১১ জন

মহেশখালীর কালামারছড়া এলাকার বাকিবিল্লাহ ও মো. ইকবাল। পরিবারের আর্থিক কষ্টের কারণে সিদ্ধান্ত নেন মালেশিয়া যাবেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা জানতে পারেন, এটি নিয়ে কাজ করেন টেকনাফ উখিয়ার কোর্টবাজার এলাকার হাজী রশিদ মিয়ার ছেলে মো. সোহাগ। তারা সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৫ লাখ টাকার চুক্তি করেন। ওই সময় সোহাগ আরও ৯ জন থেকে ৫ লাখ টাকা করে নেন। তারা হলেন-মহেশখালীর মো. মহিউদ্দিন, মো. বেলাল, শাহরিয়ার, মো. এমরান, কক্সবাজারের মো. জাবেদ, টেকনাফের মো. গিয়াস উদ্দিন, মহেশখালীর গৌরকঘাটা এলাকার মো. আরমান, একই এলাকার আনসারুল করিম ও বাবুল মিয়া।

সোহাগ এদের সবার থেকে টাকা বুঝে নেন। সবাই ইসলামী ব্যাংকে সোহাগের অ্যাকাউন্ট নাম্বার ২০৫০০০৫০২০১২৫৯৪১৪ ও আরো বেনামে তিনটি অ্যাকাউন্ট নাম্বারে ৫৫ লাখ টাকা পাঠান। এই সংক্রান্ত ডকুমেন্ট আমার দেশের কাছে সংরক্ষিত আছে। টাকা নেয়ার পর বুঝে নেন প্রত্যেকের পাসপোর্টও। সোহাগ আবার নীলনদ ওভারসিজের মালিক মো. সাগরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন। নীলনদ ওভারসিজ এদের ভিসা প্রক্রিয়ার কাজ করেন। কথা ছিল ৩ মাসের মধ্যে অর্থাৎ এই ১১ জনের ভিসা দেয়ার কথা গতবছরের মার্চের মধ্যে। কিন্তু সময়সীমার দু’মাস পর ২৮ মে সবার মুঠোফোনে হঠাৎ ক্ষুদে বার্তা পাঠায় সোহাগ। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ওইদিনই রাত সাড়ে ৮টায় ফ্লাইট বলে জানানো হয়।

এমন পরিস্থিতিতে সবাই সোহাগকে কল করলে, তার ব্যক্তিগত ফোনটি বন্ধ পায়। এমন অবস্থায় পরেরদিন ২৯ মে সোহাগ ও নীলনদ ওভারসিজের মালিক সাগরের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগীরা।

পল্টন থানা থেকে কুখ্যাত পাচারকারীকে ছিনিয়ে নেন ওসি ফজলুর

পল্টন থানায় অভিযোগ দেওয়ার পরপরই অভিযানে নামে পুলিশ। ২৯ মে বিকেলে নীলনদ ওভারসিজের মালিক সাগরকে থানায় নিয়ে আসেন দায়িত্বরত এসআই মো. মেহেদি। সাগরকে চাপ দিয়ে কুখ্যাত সেই পাচারকারী মো. সোহগকে থানায় নিয়ে আসা হয়। এই খবর পেয়ে বর্তমানে চট্টগ্রামের ডিবির ওসি (ওইসময় ছিলেন সিআইডিতে) ফজলুর কাদের চৌধুরী থানায় ছুটে যান। এসআই মেহেদী থেকে অনেকটা ছিনিয়ে নিয়ে পল্টন বিএনপির কার্যালয়ের পাশের একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যান।

আমার দেশের কাছে ওইদিনের বৈঠকের ভিডিও ও ছবি এসেছে। সেখানে দেখা যায়, ওসির ডান পাশে ছিলেন পাচারকারী সোহাগ। ভুক্তভোগীরা কথা বলতে চাইলে, ধমক দিয়ে থামিয়ে দিচ্ছেন ওসি। বৈঠকে ১১ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে প্রতারক সোহাগ ও সাগরও ছিলেন। ওসি ফজলুর কাদের নিজ জিম্মায় নিয়ে সোহাগ ও সাগরকে মুক্ত করে দেন।

ভুক্তভোগীর পক্ষে ছিলেন মো. শাকিল। তিনি আমার দেশকে বলেন, বৈঠকে ওসি ফজলুর কাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভিসা ও পাসপোর্ট ফেরত দিবে বলেছিলেন। ভিসা দিতে না পারলে টাকা ফেরত দেবে বলেছিলেন। কিন্তু এক সপ্তাহ না, এখন ৯ মাস হতে চললেও ভিসা-পাসপোর্ট পেলাম না। শুনলাম, সোহাগকে বিদেশে পালাতে সহায়তা করেছেন ওসি।

এই বিষয়ে পল্টন থানার এসআই মো. মেহেদি আমার দেশকে বলেন, থানায় অভিযোগ দেয়ার পর পাচারকারী ও প্রতারককে থানায় নিয়ে আসি। পরে, ফজলুর কাদের স্যার আমার কাছ থেকে নিজের জিম্মায় নিয়ে নেন। তাদের নিয়ে যান পল্টন বিএনপির কার্যালয়ের পাশের একটি রেস্টুরেন্টে।

আন্তর্জাতিক গ্যাংদের সঙ্গে যোগাযোগ ওসির, পাচারকারীকে বিদেশ পালাতে সহায়তা

ভুক্তভোগী ১১ জনের টাকা মেরে দেওয়ার খবর চাউর হলে, বাকি অন্তত আরো ৩০-৩৫ জন ভুক্তভোগী খুঁজতে থাকে সোহাগকে। একসময় মানবন্ধনেরও প্রস্তুতি নেন তারা। এই খবর ওসি ফজলুর জানার পর দ্রুত সোহাগকে বিদেশে পালাতে সহায়তা করেন ওসি। তিনি ২০২৪ সালের ১৫ জুন পালিয়ে যান মালেশিয়ায়। ১১ জনের মধ্যে দুজন বাকিবিল্লাহ ও মো. ইকবাল আরও ২ লাখ টাকা দিয়ে অবৈধ পথে মালেশিয়া নিয়ে যান সোহাগ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক্ষেত্রে তিনি দুটি আন্তর্জাতিক গ্যাংস্টার ও একটি বাংলাদেশি এজেন্সির সহায়তা নেন। প্রথমে ‘বস রমজান’ নামে বাংলাদেশের এজেন্সি গত ১৫ জুলাই রিসিভ করেন তাদের। তারপর এদের ভারতের কলকাতা নিয়ে যান। এর পর আকাশ পথে ভিয়েতনাম যান এই দুজন। সেখানে তাদের রিসিভ করেন ‘এসপি কোম্পানি’। জঙ্গল পথে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড তারপর মালয়েশিয়া যান তারা। তাদের ১৫ দিনের এই জার্নি ছিল কষ্টের বর্ণাতীত। মালেশিয়া গিয়ে ‘রনি মজুমদার’ নামে ওই গ্যাংস্টার এই দুজনকে আটকে রাখেন। এদের সঙ্গে ছিলেন আরও ১৫ বাংলাদেশি।

আলো-বাতাসহীন এক ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে বাকিবিল্লাহসহ ওই ১৫ জনকে আটকে রাখা হয়। টাকার জন্য হাত-পা ও চোখ বেঁধে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। বাকিবিল্লাহ ও ইকবালের পরিবার মালেশিয়ায় থাকা প্রতিবেশি মো. শাকিলের সহযোগিতা নেন। তিনি বাংলাদেশে দুই লাখ ও সেখানে ‘রনি মজুমদারকে’ মালেশিয়ান ৩ হাজার রিংগিত করে মোট ৬ হাজার রিংগিত যা বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেন।

মো. শাকিল আমার দেশকে বলেন, তাদের পরিবার আমার প্রতিবেশী। আমার সাহায্য চাইলে, তাদের টাকা দিয়ে মুক্ত করে আনি।

ভুক্তভোগী ইকবাল ও বাকিবিল্লাহ বলেন, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১৫ দিনে মালেশিয়ায় আসি। সেখানে এক গ্যাংস্টার টাকার জন্য আটকে রাখে ৩০ দিন। বেঁচে আছি, সেটি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।

যা বলছে আন্তর্জাতিক গ্যাংস্টার ও অভিযুক্ত ওসি

মালেশিয়ায় অবৈধ পথে যাবো বলে এই প্রতিবেদক মালেশিয়ান ওয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে যোগাযো্গ হয় ‘এসপি কোম্পানি’ ও ‘রনি মজুমদার’ সঙ্গে। এই দুটি সংস্থায় ওসি ফজলুর কাদেরের নাম বলেছেন। রনি মজুমদার আমার দেশকে বলেন, টাকা মাইর যাবে না। আপনার কোনো বিপদও হবে না। সেখানে আপনাকে নিরাপত্তা দিবে ওসি ফজলুর কাদের স্যার।

প্রতারণার বিষয়টি অস্বীকার করেন ‘বস রমজান’ বাংলাদেশী এজেন্সিটি। কুখ্যাত পাচারকারী সোহাগের সঙ্গে ৫ দিন চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে নীলনদ ওভাসীজের মালিক সোহাগ আমার দেশকে বলেন, সোহাগ প্রতারণা করেছে, আমার এজেন্সি কোনো প্রতারণা করেনি। ওইদিন থানায় যাওয়া ও ওসি ফজুলর কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করেন তিনি।

ডিবির ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরী জানান, পল্টন থানার ঘটনার কথা জানা নেই তার। মানবপাচারের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। পরে, তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন এই প্রতিবেদককে।

সুত্র: আমার দেশ


আরো খবর: