কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এসএম ছৈয়দ আলমের বিরুদ্ধে ভিজিডির (ভিডাব্লিউবি) চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
দীর্ঘদিন ধরে ভিজিডি ( ভিডাব্লিউবি) কার্ডধারী বেশকিছু ভাতাভোগীর কার্ডের বিপরীতে তাদের প্রতি মাসের বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাতের উদেশ্যে বিভিন্ন ভাবে তুলে নেন চেয়ারম্যান, মেম্বার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা যোগসাজশে । সেইসঙ্গে উপজেলা ট্যাগ অফিসার উখিয়া খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডি মোহাম্মদ আবু নাঈম ভূইয়া’র সঠিক তদারকির অভাবে প্রায় প্রতিটি মাসের ভিডাব্লিউবি’র চালের ডিও উত্তোলনের পরও উপকারভোগীদের মধ্যে বিতরণ না করার অভিযোগ উঠেছিলো তাঁর বিরুদ্ধে।
তাই এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে এলাকার মানুষ চরম ক্ষুব্ধ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত সঠিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।
অভিযোগর ভিত্তিতে সরেজমিনে ভিডাব্লিউবি চাল কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, বিগত বছরের চাল চলতি বছরে না দেওয়া এবং চলতি বছরের চাল বিতরণে সুক্ষ্ম কারচুপি ও বিক্রির উদ্দেশ্যে মজুদের অভিযোগ। ৩১৯ টি চালের বস্তা জব্দ করে মাস্টার রোল নিয়ে গেছে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হাবিবা জাহান।
এছাড়া দেখা যায় কার্ডধারী উপকারভোগী মহিলাদের আহাজারি। চাল বিতরণকারীদের সাথেও হচ্ছে বাকবিতন্ডা। কেউ বলছে ৩ মাস বকেয়া, কেউ বলছে ৪ মাস বকেয়া। সব বকেয়া চাল তারা ফেরত পেতে করছে প্রতিবাদ। ঘটনাস্থলে একেরপর এক এমন অভিযোগে মাস্টাররোল চেক করে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। চেয়ারম্যান, মেম্বার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা কারসাঁজি করে মাস্টাররোলে টিপসই নিয়ে চাল দেওয়া হয়েছে বলে সব ঠিকটাক করে রেখেছেন যাতে কেউ অভিযোগ করলে চাল পেয়েছে বলে দায় সারতে পারেন, এবং বিতরন না করা চাল যাতে সহজে আত্মসাৎ করা যায়। অথচ কার্ডধারী মহিলাদের কার্ড চেক করে দেখা যায় তারা ঠিকই চাল পাইনি এবং টিপসই এর ঘর খালি। বকেয়া মাস আর চাল পাওয়ার মাসগুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে কার্ডে। যা লুকায়িত করার সুযোগ নেই। চাল পেলে টিপসই এবং প্রদানকারীর স্বাক্ষর থাকে এইসব কার্ডে।
ভিডাব্লিউবি চাল কার্ডধারী মহিলা ১নং ওয়ার্ডের মনোয়ারা বেগমের চালের কার্ডে দেখা যায় সেপ্টেম্বর মাসের চাল পাইনি। অথচ মাস্টাররোলে চাল পেয়েছে বলে জাল করে টিপসই দেওয়া হয়েছে।
একই ওয়ার্ডের রিজিয়া বেগমের কার্ড চেক করে দেখা গেছে জুন, আগষ্ট দুই মাসের চাল পাননি তিনি। কোন কর্মকর্তার স্বাক্ষর বা চাল পেয়েছে এরকম কোন টিপসইও নেই তার কার্ডে। সেই বইয়ের মাস্টাররোলেও দেখা গেছে রিজিয়া বেগম চাল পেয়েছে মর্মে জালিয়াতির মাধ্যনে টিপসই । এরকম অসংখ্য কার্ডধারী মহিলা চলতি বছরের ভিজিডি কার্ড শেষ হওয়ার আগে দিক-বেদিক ছুটছে তাদের বকেয়া চাল গুলো পেতে।
অনেকেই বলছে সরকারি গুদামে চাল নেই বলে তাদের নিয়মিত আশ্বাস দিয়ে চলতি বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত থামিয়ে রাখা হয়ছিল। এই চক্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও যখন তারা বকেয়া চাল পাচ্ছে না তখনই সাংবাদিকদের এসব তথ্য দিতে বাধ্য হন তারা।
এদিকে, খাদ্যগুদাম সূত্রে জানা গেছে, যতজন উপকারভোগী রয়েছে তালিকা অনুযায়ী সকলের জন্য চাল গেছে পরিষদে। কারো চাল বকেয়া নেই। একমাস বকেয়া থাকলে তা পরের মাসে ঠিকই পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এ বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের গ্রাম-পুলিশ রশিদ আহমেদ বলেন, এইখানে অনেক দুর্নীতি অনিয়ম হলেও কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমরা ছোট লেভেলের কর্মচারী, চোখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া কাউকে তো এসব বিষয়ে বলতে পারি না।
জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বলেন, যে উপকারভোগীদের কার্ডে মাসভিত্তিক খালিঘর রয়েছে তারা আসলেই চাল পাইনি। যে সকল কার্ডধারী বকেয়া বলে পরিষদে ঘুরছে তারা সকলেই চাল পাবে। তবে কিছু জটিলতার কারণে একটু গড়মিল হয়েছে।
জানতে চাইলে চেয়ারম্যান এস এম ছৈয়দ আলম বলেন, ভিডাব্লিউবি চাল দুর্নীতি অনিয়মে আমার হাত নেই। জানি না কেনো এমন হয়েছে। আমি শপথ করে বলতে পারব কারো এক টাকার চাল খাইনি। তবে দেখতেছি চালের কার্ড আর মাস্টাররোলে বেশ কিছু গড়মিল রয়েছে।
জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের ভিডাব্লিউবি চাল কার্যক্রমে দুর্নীতি অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হাবিবা জাহান। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে কার্ডের অনেক গড়মিল পাওয়া গেছে। উপকারভোগীরা কেন চাল গুলো পাইনি আমরা ইউএনও মহোদয়ের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হোসেন চৌধুরী জানান, আমরা শুনেছি জালিয়াপালংয়ের বিষয়টি। পরিষদের সকল উপকারভোগীদের কার্ড এবং মাস্টাররোল গুদামে জমাকৃত চাল জব্দ করতে আমাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছি। চাল কার্যক্রমের যাবতীয় নথি সবকিছু তদন্ত করে এসবে যারা জড়িত এবং প্রকৃত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) হতদরিদ্র উপকারভোগীদের চাল বিতরণ না করে বিক্রির উদ্দেশ্যে মজুদ করার অভিযোগের বিষয়টি নজরে আসলে সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গুদামে তালা দিয়েছলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) যারীন তাসনিম তাসিন। তিনি জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদে অতিরিক্ত চাল মজুদ রাখার বিষয়ে পরিদর্শন করে এক ওয়ার্ডে বিতরণ না করা চাল বিতরণের নির্দেশ দিলে এ নিয়ে বহুল বিভিন্ন গনমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ হয়। তারই ফলশ্রুতিতে ২৯ ডিসেম্বর (রোববার) এক নাম্বার ওয়ার্ডে চাল বিতরণ করা হয়।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বেও জালিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম সৈয়দ আলম ভিজিডির কার্ডধারীদের চাল নিয়ে চালবাজি করার কারনে তৎকালীন উখিয়ার ইউএনও ইমরান হোসাইন সজীব জালিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাস্টার রোল জব্দ করে নিয়ে গিয়ে ছিলেন এবং তৎকালীন ট্যাক অফিসার উপজেলা সমবায় অফিসার সলিম উদ্দিনকে দায়িত্ব অবহেলার দায়ে ট্যাক অফিসারের দায়িত্ব খেকে সরিয়ে দেন। এছাড়াও নৌকার চেয়ারম্যান এসএম সৈয়দ আলমের অনিয়ম দূর্নীতি সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে ইমরান আল মাহমুদ নামের এক গণমাধ্যমকর্মী হামলা ও মামলা শিকার হয়েছে।