এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বিস্ময়কর এবং চিন্তার খোরাক জোগায়। ছেলে-মেয়ে যখন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, সংসারে সুখের দিন আসবে তখনই বাবা-মায়ের ওপারের ডাক আসে কিংবা বার্ধক্যজনিত দুর্বলতায় বিছানায় ঠিকানা হয়। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিকসহ কতশত রোগ সুখের দিনগুলোকে উপভোগ করতে দেয় না। সন্তানকে বড় করতে, মানুষ করতে যে পিতামাতা সমস্ত জীবনটাতে সেক্রিফাইসের পিরামিড গড়লো তারা জীবনের সখ-আহ্লাদ ছাড়াই গল্পের আড়ালে চলে যায়। নিজেদের জন্য কোনদিন ভালো জামা-কাপড় কেনে নি, সখ পূরণে সমস্ত ব্যয় করেনি, ভালোকিছু খায়নি কিংবা ভোগের স্বপ্ন বিভোর না হয়ে কেবল ছেলেমেয়েদের ভালো রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টায় জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষগুলো ত্যাগেই সুখ খুঁজে নিয়েছে।
অথচ যখন সময় এসেছে, ছেলেমেয়েরা ঘুরতে নিয়ে যেতে পারে, ভালো পোশাক দিতে পারে, অনেক খাবার কিনতে পারে তখন সে মানুষ দু’জন নাই কিংবা বাঁচলেও অত্যন্ত মাজুর। যখন খাদ্যের চেয়ে ওষুধ দরকার হয় বেশি তখন মানুষের ভাগ্য ফেরে কিন্তু সময়-স্বাস্থ্য আর ফেরে না। সুদিন ফেলে এসেছে অনেক দিন হলো! তা এখন অনেক দূরের অতীত। ভালো ফলমূল খেতে ইচ্ছা করে কিন্তু শরীর হজম করতে পারে না, দূরে বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করে কিন্তু পা সায় দেয় না। যার জীবনটা দুঃখে যায় তারও গোটা সময়টা দুঃখে কাটে না। তবে যারা মনেপ্রাণে বাবা-মা হয়েছে তাদের জীবনটা ত্যাগে ত্যাগেই কাটে। নিজে ভোগ না করে, রোগ পুষে রেখে সন্তানের জন্য ‘ভালো আছি’ থাকার সিঁড়ি-সেতু নির্মাণ করে। সন্তান যখন বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারে তখন সময় ফাঁকি দিয়েছে।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সবচেয়ে বেশি দরকার যত্ন। কথা বলার মানুষ এবং পাশে থাকা মানুষ। অথচ আধুনিক দাসত্বের যুগে বাবা-মা বৃদ্ধকালে চরম একা হয়ে যায়। বড় সংসার কাটতে ছাটতে আবার দু’জনে পৌঁছে! তারা চোখের সামনে সম্পদ দেখে কিন্তু সন্তানের ছায়া-কায়া দেখে না। সবাই সবার মত ব্যস্ত। বিশেষ উপলক্ষ্য ছাড়া ঘরে ফেরা হয় না। বাবা-মা চাতকের মত চেয়ে চেয়ে অপেক্ষা করে কিন্তু বেলাশেষে কেউ ঘরে ফেরে না। কাজেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দুঃখ ফুরায় না। আবার কোথাও কোথাও বৃদ্ধ বাবা-মা সন্তানদের সংসারেও ঠাঁই পায় না। যখন দুঃখ ঘিরে ধরে তখন মৃত্যু কামনা করতে শুরু করে। অসহায়ত্বের দিনগুলোতে বাবা-মায়ের দুঃখ কমে না।
আমাদের বাবা-মাকে ভালো রাখার সার্বক্ষণিক চেষ্টা ও মঙ্গলের প্রার্থণাতে আমরাও যাতে বুড়ো হই। বাবা-মায়ের ইচ্ছা যেনো প্রথম সুযোগেই পূরণ করি। অন্যকিছুর জন্য না, তাঁরা কেবল বাব-মা এই পরিচয়ের কারণেই তাদের সেবায় একজীবন পার করে দিলেও ঋণের সিকিভাগ শোধ হবে না। বাবা-মায়ের সন্তুষ্টি সন্তানের জীবনকে আলোকিত করে। তাদের পাশে থাকা, সাথে রাখার মাধ্যমে জীবন বরকতময় হয়ে ওঠে। উল্টো কিছুও করতে পারেন কিংবা ভাবতে পারেন! তবে এর পরিণতি মঙ্গলের হবে না।
ক’দিন বাকি বাবা/মা হওয়ার? বেশি দূরে বৃদ্ধ হাওয়া? যা করে যাবো তাই ফিরে পাবো। বাবা-মাকে সন্তুষ্ট না করে তাদেরকে রবের ডাকে ফিরতে দিয়েন না। ফেরা তো আর আটকাতে পারবেন না তাই সবসময় তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখার কসরত করুন। পিতামাতা নারাজ হলে রবের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। কাজেই পিতামাতার কল্যাণ সাধন করুন, সেবা করুন এবং তাদের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করুন। যারা রত্ন হারিয়ে ফেলেছেন তারা রবের শেখানো পথে চোখের পানি ছাড়ুন। এই দুনিয়ায় সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের চেয়ে বড় কোন নেয়ামত হয় না। নেয়ামত নষ্ট করলে কেয়ামত বরবাদ হবে। বাবা-মায়ের সুখের তালাশে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। বাবা-মা যদি কষ্ট পায়, এমনকি ‘উঁহু’ বলে তবে জান্নাত নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। তবে আশার কথা, মন থেকে সন্তানের অমঙ্গল কোন বাবা-মা প্রত্যাশা করেন না। বাবা মা সন্তানকে বদদোয়া দেন না। তাদের এই উদারতাতেই সন্তানের জীবনে সুখ আসে, আলো হাসে।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
[email protected]