দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হতে না হতেই নতুন করে উখিয়ায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। চলছে সম্ভাব্য মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা। চলছে ভোটের হিসাব নিকাশ। প্রার্থীদের মধ্যে কার কোনটি বাড়তি সুবিধা কিংবা অসুবিধা এই সব নিয়ে চলছে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ।
কোন দিকে যাচ্ছে রাজনীতির ম্যার-প্যাঁচ, ভোট ব্যাংক, প্রার্থীর ইমেজ, এই গুলো রয়েছে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুতে। পাশাপাশি রয়েছে উখিয়া-টেকনাফের ভোটের ম্যাজিকম্যান খ্যাত সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি সমর্থন কে পাচ্ছেন সেটা। ভোটের মাঠে আবদুর রহমান বদির তুলনায় আবদুর রহমান বদিই। তার রাজনৈতিক কৌশল ও জনপ্রিয়তার কাছে অন্যরা বারবারই ধরাশায়ী হয়েছেন অতীতে। এছাড়াও বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল বা নেতা কর্মীদের সমর্থন পাওয়ার অর্থ হলো নির্বাচনের দৌড়ের অর্ধেক এগিয়ে থাকা। পাশাপাশি আলোচনায় রয়েছে ভোটের রাজনীতিতে উখিয়ার প্রভাবশালী নেতা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, চেয়ারম্যান নুরুল হুদা, চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল আলম চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ আলম, সাবেক উপজেলার চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক চৌধুরীসহ অন্যান্যরা কোন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন সেটা।
অতীত নির্বাচনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি যে প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন সেই প্রার্থীই শেষ পর্যন্ত বিজয়ের মালা পড়েছেন। সেটা হোক সংসদ নির্বাচন, সেটা হোক উপজেলা পরিষদের নির্বাচন, সেটা হোক ইউপি নির্বাচন বা সেটা যে কোন নির্বাচনই। এবারও উখিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এর ব্যতিক্রম হবে না বলে স্থানীয় সচেতন মহলের ধারণা।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্য থেকে জয় ছিনিয়ে আনতে হলে আবদুর রহমান বদির কূটকৌশল বুঝেই প্রার্থীদের এগোতে হবে! পুরো উখিয়া উপজেলায় তার নিজস্ব বিশাল একটা ভোট ব্যাংক ও অসংখ্য রাজনৈতিক অনুসারী রয়েছে।
আবদুর রহমান বদির মাঠ পর্যায়ের জনপ্রিয়তা, ক্ষমতা, আন্তরিকতা,দানশীলতা ও তার বিচক্ষণতাকে পুঁজি করে ভোটের সব হিসাব নিকাশ মুর্হুতের মধ্যে পাল্টে দেওয়ার রেকর্ড অতীতে অনেকবার দেখেছেন উখিয়াবাসী।
আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী, পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীদের নিয়ে।
আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হিসাবে আপাতত যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা হলেন রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের টানা ৩ বারের চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক চৌধুরী, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল মনসুর চৌধুরী, উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ চৌধুরী।
পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে আপাতত যাদের নাম শোনা যাচ্ছেন, তারা হলেন উখিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এম জাহাঙ্গীর আলম, হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন চৌধুরী মিন্টু, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেল চৌধুরী, উখিয়া উপজেলা জামায়াতে ইসলামী আমীর মাওলানা আবুল ফজল ও উখিয়া প্রেস ক্লাবের সাবেক সহ সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক গফুর মিয়া চৌধুরী।
মহিলা ভাইস প্রার্থী হিসাবে আপাতত যাদের নাম শোনা যাচ্ছেন, তারা হলেন উখিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও নিজস্ব প্রচেষ্টায় ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে উখিয়ার গ্রামগঞ্জের চিত্র বদলে দেওয়া কামরুনেচ্ছা বেবি, জনগনের সরাসরি ভোটে প্রথম নির্বাচিত সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহিন আক্তার, জালিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের বারবার নির্বাচিত মহিলা মেম্বার ফরিদা ইয়াসমিন ও মরিচ্যার সানজিদা মায়া।
উখিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান কামরুনেচ্ছা বেবি একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। তার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবদুর রহিম কন্টাক্টর সাবেক একজন প্রভাবশালী ছাত্র নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংগঠনিক নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন রামু উপজেলার খুনিয়া পালং ইউনিয়নের বাসিন্দা। কামরুনেচ্ছা বেবি হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আমিনুল হক আমিনের স্ত্রী। এছাড়াও দৈনিক জনসংযোগ পত্রিকার সম্পাদক, স্যাটেলাইট টেলিভিশন আরটিভি’র কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি ও উখিয়া প্রেস ক্লাবের সহ সভাপতি সাইফুর রহিম শাহিন তার (কামরুনেচ্ছা বেবির) বড় ভাই।
গৃহিণী থেকে রাজনীতিতে পদার্পণ করার পর তিনি প্রখমবারই সবাইকে চমক দেখিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সরকারি ভাবে ভাইস চেয়ারম্যানদের জন্য কোন বরাদ্দ না থাকার পরও জনপ্রতিনিধি হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর কামরুনেচ্ছা বেবি উখিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদাসহ সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সাবেক সংসদ সংসদ আবদুর রহমান বদি ও বর্তমান সংসদ সদস্য শাহিন আক্তারের আন্তরিক সহযোগিতার বদৌলতে উখিয়া উপজেলার গ্রামগঞ্জে দৃশ্যমান ব্যাপক উন্নয়ন করে গেছেন। যা অতীতে কোন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পক্ষে সম্ভব হয়নি বলে স্থানীয় সচেতন মহল মত প্রকাশ করেছেন।
কামরুনেচ্ছা বেবি উখিয়া উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সক্রিয় ভাবে মাঠে ময়দানে কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি এসএসসি ৯৯ ব্যাচের অন্যতম একজন সক্রিয় সদস্য। তার পিতার বাড়ি রামুর খুনিয়া পালং ইউনিয়নের ধেছুয়া পালং গ্রামে, শ্বশুর বাড়ী উখিয়ার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের পাগলীর বিল গ্রামে। তার স্বামী আমিনুর হক আমিন একজন সফল জনপ্রতিনিধি ও স্পষ্টবাদী রাজনৈতিক নেতা হিসাবে পুরো উপজেলায় বেশ পরিচিতি রয়েছে, তার সেই রাজনৈতিক পরিচিতি ও কমিউনিকেশন এবং জনপ্রিয়তাসহ সব কিছু মিলিয়ে কামরুনেচ্ছা বেবির সাথে লড়াই করে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয় হওয়া অন্য প্রার্থীদের জন্য হিমালয়ের পাহাড় ডিঙ্গানো মতো কঠিন হবে বলে মনে করেন স্থানীয় ভোটাররা।
জনগনের ভোটে উখিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়ে ছিলেন শাহিন আক্তার। তিনি প্রথম বারের মতো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে সামান্য ভোটের ব্যবধানে হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন মহিলা মেম্বার খোরশেদা করিমকে পরাজিত করে প্রথম উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। তবে পরবর্তীতে পরপর ২ টি উপজেলা নির্বাচনে রহস্য জনক কারনে তিনি অংশ গ্রহণ করেননি এবং এলাকায়ও ছিলেন না। কিন্তু আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবার নির্বাচন করবেন বলে তার পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে। তবে তিনি এখনো আনুষ্ঠানিক ভাবে কোন দলীয় ফোরাম বা কোন সভা-সমাবেশে বা মিডিয়া কর্মীদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি।
শাহিন আক্তার জালিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ৪ বারের চেয়ারম্যান আহমদ শরীফ চৌধুরী ছোট মেয়ে। উখিয়া উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি জনপ্রিয় শিক্ষক কামাল উদ্দিনের স্ত্রী। তার পিতার বাড়ি উখিয়ার জালিয়া পালং ইউনিয়নের মনখালী গ্রামে আর শ্বশুর বাড়ী উখিয়ার রত্না পালং ইউনিয়নের চাকবৈঠা গ্রামে। জালিয়া পালং ইউনিয়ন ও রত্নাপালং ইউনিয়নের ভোটারদের মধ্যে যদি সমন্বয় ঘটাতে পারেন তাহলে তিনি একজন শক্ত প্রার্থী হিসাবে নিজেকে আবির্ভাব ঘটাতে পারবে বলে সচেতন ভোটাররা মনে করেন।
শাহিন আক্তার সক্রিয় ভাবে কোন রাজনৈতিক দল বা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়। তবে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে অসমর্থিত সুত্রে জানা গেছে। এছাড়াও তিনি এসএসসি ৯৪ ব্যাচের একজন সক্রিয় কর্মী।
উখিয়ার জালিয়া পালং ইউনিয়নের সম্ভ্রান্ত শিক্ষক পরিবারের মেয়ে ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি জালিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের ৪,৫ ও ৬ ওয়ার্ডের বর্তমান মহিলা মেম্বার। ফরিদা ইয়াসমিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সক্রিয় উপজেলা পর্যায়ের একজন নেত্রী। তিনি জালিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এস এম সৈয়দ আলমের অনুপস্থিতিতে দীর্ঘ সময় সুনামের সাথে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এর দায়িত্বও পালন করে গেছেন। জালিয়া পালং ইউনিয়নে বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় তার বিশাল একটা ভোট ব্যাংক রয়েছে এই ইউনিয়নে।
তাছাড়া তিনি বিএনপির দলীয় সমর্থক ভোটারদের যদি সমর্থন আদায় করে নিতে পারেন তাহলে তিনিও অপ্রতিরোধ্য একজন প্রার্থী হয়ে দাড়াবে বলে বিএনপি নেতা-কর্মীরা মনে করেন। তিনি এসএসসি ৯৩ ব্যাচের একজন সক্রিয় সদস্য। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হবে কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার মো: ইসলামের পুত্রবধূ সানজিদা মায়া এবার প্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে, তার তেমন কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয় নেই। অভিযোগ রয়েছে তার পূর্ব পুরুষ মায়ানমারের নাগরিক। যার কারনে সানজিদা মায়া ছাড়া তার পিতার পরিবারের আর কেউ এখনও বাংলাদেশে ভোটার হতে পারেনি! অভিযোগটি কতটুকু সত্যি বা মিথ্যা এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে এলাকায় জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি বার্মাইয়া লালু হাজীর মেয়ে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞজনদের মতে বিএনপি নেতাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা ও না করা এবং সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন পাওয়ার উপর প্রার্থীদের জয় পরাজয় অনেক কিছু নির্ভর করবে। আগামীর মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কে হচ্ছেন সেটা দেখতে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে উখিয়াবাসীকে। তবে এখন থেকেই ভোটের মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
বিএনপি বা জামায়াত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলে সেক্ষেত্রে সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর পরিবারের সমর্থনও প্রার্থীদের জন্য বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিবে ভোটের মাঠে। ঝানু রাজনীতিবিদ শাহজাহান চৌধুরীর ইশারায় এখনও অনেক কিছু হতে পারে সেটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তার দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা।