২০১৯ সালে মাসের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে উখিয়ার কুতুপালং এক্সটেনশন-৪-এ রোহিঙ্গা গণহত্যাবিরোধী যে মহাসমাবেশ হয়েছিল, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। গণহত্যাবিরোধী ওই সমাবেশ পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা জড়ো হন। ওই সমাবেশে তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিত্ব প্রদান, নিরাপত্তা, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটা ফেরতসহ সাত দফা দাবি জানিয়েছিলেন। একই বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বিশ্ববাসীর নজর কাড়েন রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে গঠিত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ।
এ অবস্থায় প্রত্যাবাসনবিরোধীরাই মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছেন তার সহকর্মী এবং অন্য রোহিঙ্গা নেতারা। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানা যায়, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে মংডু টাউনসিপের সিকদার পাড়া প্রাম থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। আশ্রয় নেন কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে। তার বাবার নাম মৌলভী সিরাজ। ব্যক্তিজীবনে মুহিবুল্লাহ ছিলেন ৯ সন্তানের জনক। মিয়ানমারে থাকতে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন বলে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের কাছে তিনি ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামে পরিচিত ছিলেন।
‘খুনিদের চিনি, নাম বললে জান থাকবে না’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সদস্যরা জানান, বুধবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে কুতুপালং মেগা ক্যাম্পের মধ্যে লম্বাশিয়ায় অবস্থিত এআরএসপিএইচ কার্যালয়ে একদল অস্ত্রধারী গুলি করে হত্যা করে শীর্ষ নেতা মো. মুহিবুল্লাহকে (৫০)।
মৃত্যুর প্রায় ১০ মিনিট আগে মুহিবুল্লাহ উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী নেত্রী জামালিদা বেগমকে ফোন করে আগামী শুক্রবার একটি বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন।
জামালিদা বলেন, বৈঠকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাবিরোধী নতুন দল এনইউজি’র বিষয়সহ প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল। মূলত আমরা দু’জনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বেশি সোচ্চার ছিলাম। এখন আর হয়তো কেউ প্রত্যাবাসন নিয়ে জোর দিয়ে কথা বলবেন না। ফলে প্রত্যাবাসনের দাবি আবারও থমকে যেতে পারে। কেননা ক্যাম্পে থাকতে আমার খুব ভয় হচ্ছে। এখানকার পরিবেশ খুব ভীতিকর। মুহিবুল্লাহ না থাকলে কারা বেশি লাভবান হতো সেটিও ভাবা উচিত। ঘটনার সময় তার সঙ্গে দু’জন সহকর্মী ছিল বলে জানান তিনি।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ রফিক বলেন, নিহত মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলার জন্য তিনি জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। রোহিঙ্গাদের অধিকার দিয়ে তিনি সব সময় বিদেশি বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করতেন। মূলত একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ রোহিঙ্গা কোনও নেতা জনপ্রিয় হয়ে উঠলে তাকে হত্যা করে। এর আগে, যেমন শওকত আলীকে হত্যা করা হয়েছিল। ফলে এখানকার রোহিঙ্গারা খুব আতঙ্কের মধ্য রয়েছে।
মুহিবুল্লাহর হাতে গড়া সংগঠন এআরএসপিএইচের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ অভিযোগ করেন, ‘রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করায় আমাদের নেতাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, যাতে আর কেউ রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে কাজ না করে। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তার এই মৃত্যু রোহিঙ্গাদের জন্য বড় ক্ষতি।’
রোহিঙ্গাদের শীর্ষ পর্যায়ের আরেক নেতা মো. জোবাইর বলেন, মুহিবুল্লাহ শুধু ১২ লাখ রোহিঙ্গার নেতা ছিলেন না, ছিলেন আমাদের অভিভাবক। তার ওপর ক্ষুব্ধ প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসীরাই তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।
জানতে চাইলে ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হক বলেন, ধারণা করা হচ্ছে হত্যাকারীরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ছিল। প্রত্যাবাসনের পক্ষে মুহিবুল্লাহ জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। আবার প্রত্যাবাসনবিরোধী একটি গ্রুপও রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় আছে, যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আপাতত ক্যাম্পের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তবে এ হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যাতে ক্যাম্পে অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে সেজন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে, লাশ দাফন শেষে মামলা দায়েরের কথা রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিজেদের দ্বন্দ্ব এবং দলীয় কোন্দলসহ অন্য কোনও কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যা থাকতে পারে সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্য আমরা কিছু নাম পেয়েছি, সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে যেকোনও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলে জানান তিনি।-বাংলাট্রিবিউন