বাংলা ট্রিবিউন::
‘আপা… লাল কাঁকড়া হাতে ধরবেন? ধরে দেই?’ কীভাবে ধরবে জানতে চাইলে ৯ বছরের রহমান (ছদ্মনাম) পকেট থেকে সুতার রিল বের করে একটা কাঁকড়ার পা বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে দিয়ে বললো— ‘নেন আপা, হাতে ধরে ঝুলিয়ে ছবি তোলেন। সবাই তোলে।’
দেশের কয়েকটি পর্যটন জায়গার মধ্যে এখন ভ্রমণের জন্য কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। বড় বড় হোটেল রেস্তোরাঁ। রঙ-বেরঙের বিচ রিসোর্ট, মেরিন ড্রাইভের মতো সমুদ্রের কোল ঘেঁসে রাস্তা, আর ঢাকা থেকে মাত্র একঘণ্টার ফ্লাইটের কারণে এর আকর্ষণ দিনি দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে পর্যটন স্পট বাইল্যাখালীর এই লাল কাঁকড়া বিচ হয়ে উঠেছে একটু নিরিবিলি চান যারা, তাদের তীর্থভূমি।
এই বিচেই কেবল না, সবকয়টি বিচে কোনও নিয়ম কেউ মানে না। যেখানে-সেখানে পলিব্যাগ ফেলায় বিচের বালুতে কয়েক স্তর পড়ে গেছে। এমনকি এতই গভীরে এই স্যাশে (মিনি প্যাক) ও প্লাস্টিক পৌঁছে গেছে যে, খুড়তে শুরু করলে কেবল নীল কালো সবুজ ব্যাগ বের হতে থাকে। আর কলাতলী, সুগন্ধা বিচে ঠাসা প্লাস্টিকের পাহাড়তো যে কারও চোখে পড়বে। যদিও জায়গায় জায়গায় প্রাণ বৈচিত্র্য রক্ষার নানা নির্দেশনা বোর্ড আকারে ঝুলানো আছে। সেসব পড়ার বা দেখার কোনও আগ্রহ কারোর মধ্যে দেখা যায় না। প্রশাসন বলছে, আমরা এই জায়গাগুলো সংরক্ষিত ঘোষণা করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। কাঁকড়া হয়রানি, প্লাস্টিক পড়ে থাকার মতো অভিযোগগুলো সামনে আসায় আমরা বিচের ওইসব জায়গা ঘিরে দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। আপাতত সেটা হচ্ছে না।
লাল কাঁকড়ার হয়রানি
কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভের রাস্তায় নামার পর থেকে বিচ এলাকা শুরু হয়ে যায়। এরমধ্যে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের বাইল্যাখালী এলাকায় অবস্থিত বিচটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সৈকতের অন্যান্য এলাকার চেয়ে ওই এলাকায় লাল কাঁকড়ার বিচরণ বেশি দেখা যায়। কিন্তু এখানে কোনও মনিটরিং নেই। ঢাকা থেকে আসা আশা-দম্পতি অনেকক্ষণ ঘুরেছেন। ছবি তোলা শেষে ফেরার আগে দুজনে দুই হাতে দুটো কাঁকড়া ঝুলিয়ে ছবি তুলতে গেলে স্থানীয় কয়েকজনের বাধার মুখে পড়েন। তাদেরই একজন রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বিচে হাঁটলে সাধারণত কাঁকড়া গর্তে ঢুকে যায়। দেখেন, ছোট ছোট অসংখ্য গর্ত। আপনি পৃথিবীর আর কোনও দেশে এমন সহিংস মানুষ পাবেন না। যারা কাঁকড়া এভাবে ১০ টাকার বিনিময়ে ধরতে বলবেন, কেবল একটা ছবি তুলে মজা নেওয়ার জন্য।’ শুধু বাইল্যাখালী সৈকত নয়, কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন এলাকা চিহ্নিত করে সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজার সৈকতে লাল কাঁকড়ার এই সৌন্দর্য অন্য কোথাও নেই উল্লেখ করে উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজিব বলেন, ‘আমরা অভিযোগগুলো পেয়েছি বলেই ওই জায়গাগুলো সংরক্ষিত করতে চেয়েছিলাম। বেড়া দিয়ে ঘিরে এমনভাবে করতে চেয়েছিলাম— যাতে লাল কাঁকড়াগুলো বিরক্ত না হয়। নিজেদের মতো বিচরণ করতে পারে। কিন্তু এটি বেশকিছু গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন হওয়ার পর আমরা আপাতত বন্ধ করে দিয়েছি। রুটিন কাজের বাইরে দায়িত্ব নিয়ে কোনও উদ্যোগ নিয়ে যদি সমালোচনার মুখে পড়তে হয়, তাহলে কাজের আগ্রহ আর থাকে না। অনেকে গাড়ি নিয়ে বিচে নেমে যায়, কাঁকড়া না ধরতে সাইনবোর্ড দেওয়ার পরেও লাল কাঁকড়া ধাওয়া করে। এসবই বন্ধ হতো যদি কাজটা করতে পারতাম।’
পা বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে হাতে দিলে ‘১০ টাকা’
সৈকতজুড়ে প্লাস্টিকের দায় আমাদেরই
কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে যেদিকে দৃষ্টি যায়, কেবলই প্লাস্টিকের ভেসে আসা আবর্জনা। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, ভাসমান দোকানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্যের শেষ গন্তব্য সমুদ্র সৈকত। গবেষণা বলছে, প্রতিদিন সৈকতে যে পরিমাণ বর্জ্য জমা হয়, তার ৭৮ ভাগই প্লাস্টিক। অথচ, শহরে প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের কোনও ব্যবস্থাই নেই। সৈকতে সুনির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও পানির খালি বোতল, কোকের ক্যান, চিপসের প্যাকেটসহ হাতের যেকোনও প্লাস্টিক দ্রব্য যেখানে-সেখানে ফেলাটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলতি বছর জানুয়ারিতে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) কার্যালয়ে ‘প্লাস্টিক টক্সিক কেমিক্যাল প্রব্লেম: এ গ্রোয়িং পাবলিক হেলথ ক্রাইসিস’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে ‘প্লাস্টিকের ছোট টুকরোয় বিষাক্ত রাসায়নিক: ঝুঁকি সৃষ্টি করছে জনস্বাস্থ্যে’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্লাস্টিকের ছোট টুকরো বিপজ্জনক রাসায়নিক ছড়াচ্ছে। কক্সবাজারের কলাতলী ও ইনানী সমুদ্রসৈকতের বালির মধ্যে ক্ষতিকর এসব প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরো পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষে এসডোসহ বিশ্বের আরও ৩৫টি দেশের বেসরকারি সংস্থা ওইসব দেশের সমুদ্রসৈকতে পাওয়া প্লাস্টিকের টুকরো আমেরিকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য পাঠায়। ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত থেকে সংগৃহীত টুকরোগুলোতে ১৮টি রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে। যেগুলোর মধ্যে ১২টি পদার্থই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
যারা পর্যটনের দায়িত্বে আছেন, যারা সৈকত সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বে আছেন, তাদের যদি ইকোলজি, ইকোসিস্টেম ইকোসার্ভিস প্রশিক্ষণ না দেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি খারাপ হবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘পর্যটন পুলিশ কোথায়? একটা সামগ্রিক দেখভালের পরিকল্পনা বানাতে হবে। এগুলো বাস্তবায়নে বন বিভাগ, পর্যটন, স্থানীয় প্রশাসন একত্রে সাপোর্ট দিতে পারে। মূল বিষয় হচ্ছে সরকারের পরিকল্পনায় যথাযথভাবে আনতে হবে।’