মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ১০:৩৪ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায় বর্জ্যের পাহাড় ধসে ১৪টি ওয়ার্ডের জনজীবন বিপর্যস্ত

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০২৫




 

কলকাতা, ২৩ মার্চ – কলকাতার লাগোয়া হাওড়া জেলায় বর্জ্যের পাহাড় ধসে ১৪টি ওয়ার্ডের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে ঘরবাড়ি। পানি সংকটে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বেলগাছিয়া বর্জ্য ভাগাড়ে মঙ্গলবার গভীর রাতে ধস নামে। এতে উত্তর ও মধ্য অংশের ১৪টি ওয়ার্ডের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বুধবার থেকে এখানকার মানুষ পানীয় জল পাচ্ছেন না। জল সরবরাহের প্রধান পাইপ ফেটে গেছে এবং তার জেরে বন্ধ হয়ে গেছে পানীয় জলের জোগান। সঙ্কটে পড়েছেন বালি পুরসভার তিনটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারাও। তবে দ্রুত জল সরবরাহ শুরুর লক্ষ্যে কাজ অনেকটা এগিয়েছে।

ধসের কারণে একের পর এক বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। কারো বাড়ির মেঝে বসে গিয়েছে। একাধিক বাড়ি একেবারে ভেঙে পড়েছে। মাথার উপর ছাদ হারিয়েছেন কেউ কেউ।

রোববার সকালেও নতুন করে ফাটল ধরেছে কোনো কোনো বাড়িতে। ফাটল দেখা দিয়েছে রাস্তায়। সেখানেও যে কোনো সময় ধস নামার আশঙ্কা। ধসের জেরে মাটির তলা থেকে জলের পাইপ উঠে এসেছে। বেঁকে ভেঙে গিয়েছে মোটা মোটা পাইপ। আবর্জনা স্তূপে তৈরি হওয়া গ্যাসের দরুণ নেমেছে ধস। এরই সঙ্গে গত কয়েক দিন ধরে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় কাটাতে হচ্ছে স্থানীয় মানুষজনকে।

বিপর্যয়ের নেপথ্যে

এই বিপর্যয়ের কেন্দ্রে রয়েছে একটি ডাম্পিং রাউন্ড বা ভাগাড়। বেলগাছিয়ার এই ভাগাড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে আবর্জনা এনে ফেলা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত দুই-তিন বছরে এই আবর্জনার পাহাড় আরো উঁচু হয়েছে। ভাগাড়ের এলাকা বাড়েনি, কিন্তু আবর্জনার পরিমাণ বেড়েছে।

বেলগাছিয়ায় যে ভাগাড় রয়েছে সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে জঞ্জাল ফেলা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই স্তূপ সরানো হয়নি। দিনের পর দিন ধরে জমতে জমতে প্রায় পাহাড়ের আকৃতি নিয়েছে জঞ্জাল; কিন্তু তার জন্য কোন বেস লেভেল পরীক্ষা করা হয়নি। এর ফলে ধস নামার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হঠাৎই ধস নামার ফলে ভিটেমাটি ছাড়ার জোগাড় হয়েছে সাধারণ মানুষের।

রাজ্যের মন্ত্রী ও হাওড়ার বিধায়ক অরূপ রায় এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে এটাকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের’ তকমা দিয়েছেন। তবে এই মত খারিজ করে দিচ্ছেন অনেক পরিবেশকর্মী ও গবেষক। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যথাযথ পরিকল্পনা না থাকার ফলে এই পরিণতি বলে তাদের মত।

তিনি বলেন, “পরিবেশ আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত আবর্জনা ব্যবস্থাপনাকে। কিন্তু হাওড়ার নাগরিক সমাজ বা পরিবেশ কর্মীরা মেছোবিড়াল নিয়ে যতটা বেশি ভাবেন, ততটা এই বিষয়ে ভাবেন না। আবর্জনা ব্যবস্থাপনা আইন মহারাষ্ট্র, গুজরাট ইত্যাদি জায়গায় চালু হয়েছে। আবর্জনার যে শ্রেণিবিভাগ করা দরকার, সেটা আমাদের এখানে নেই। ডাম্পিং গ্রাউন্ডগুলিতে সবকিছু একসঙ্গে ফেলে রাখা হয়।”

হাওড়া জেলায় জঞ্জাল নিষ্কাশন নিয়ে ঢিলেমির অভিযোগ বারবার উঠেছে। এমনকি হাওড়া শহরেও আর্বজনা ব্যবস্থাপনা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ নিয়ে মামলা চলছে জাতীয় পরিবেশ আদালতে (এনজিটি)।

আদালত মনে করছে, এ নিয়ে অনেক আলোচনা ও শুনানি হয়েছে, এ বার কাজ করা দরকার। আদালত গত মাসের শেষে বলেছে, হাওড়ায় নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শহরের জঞ্জাল সাফাইয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলতে হবে। আগামী ১৫ এপ্রিল এই মামলার পরবর্তী শুনানি। তার আগে শহর লাগোয়া জায়গায় অনেক বড় বিপর্যয় ঘটে গেল।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস বলেন, “ডাম্পিং গ্রাউন্ডের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা সংক্রান্ত একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে। আপনি চাইলেই বছরের পর বছর সেখানে আবর্জনা ফেলতে পারেন না। যত জঞ্জালের স্তূপের উচ্চতা বাড়তে থাকে, তত সেই অঞ্চলের মাটির উপর চাপও বাড়তে থাকে। মাটির ধারণ ক্ষমতাকে যদি সেই চাপ ছাপিয়ে যায়, তাহলে বিস্তীর্ণ এলাকায় ধস নামা সম্ভব। এতে বাড়িতে ফাটল ধরবে, জলের পাইপ ফেটে যাবে, অন্য বিপর্যয় হতে পারে।”

বিশেষজ্ঞদের মত

রোববার সকালে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট-এর একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। বিজ্ঞানী, গবেষকদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাবেক বিভাগীয় প্রধান সাধনকুমার ঘোষ। তারা বেলগাছিয়ার ভাগাড় সরেজমিনে দেখেন।

সাধনকুমার ডিডাব্লিউকে বলেন, “ডাম্পিং গ্রাউন্ড যে জমির উপর থাকে, তার ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। যদি কোনো ভিত্তি কাঠামো তৈরি করা হয় বা পাইলিং করা হয়। এখানে হয়ত অতীতে কিছু হয়েছিল। কিন্তু গত ২০-২৫ বছরে এ ধরনের কিছু করা হয়নি। ধারণ ক্ষমতার অনেক বেশি আবর্জনা জমানোর ফলে এই মাটিতে ফাটল ধরে গিয়েছে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ডাম্পিং গ্রাউন্ডের ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ হয় না, যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। শুধু ট্রাকে করে আবর্জনা এনে এখানে ফেলে দেয়া হয়। পুনর্ব্যবহার করার তো প্রশ্নই নেই।

পচনশীল কঠিন বর্জ্য দীর্ঘদিন জমে থাকার ফলে পচে যায়। ডাম্পিং গ্রাউন্ডের মধ্যেই এর ফলে তৈরি হয় মিথেন গ্যাস। এই গ্যাস নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে। কঠিন বর্জ্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর ফলে ভাগাড়ের ভিতরে তৈরি হয় শূন্যতা। একই সঙ্গে গ্যাস বাইরে বেরোনোর রাস্তা খোঁজে। এ সবের জন্য একটা বিপর্যয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে হাওড়ায়।

এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করেন সাধনকুমার। বলেন, “পুনর্ব্যবহার করার কাজ এখানে কিছুই হয়নি। তাহলে ডাম্পিং ইয়ার্ড তৈরি হত না। আমরা কোটি কোটি টাকার সম্পদ এভাবে নষ্ট করছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা দরকার এই আবর্জনা পুনর্ব্যবহার করা হলে অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। একইসঙ্গে পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখা যায়।”

সূত্র: ঢাকা পোস্ট
এনএন/ ২৩ মার্চ ২০২৫



আরো খবর: