নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর ইতিহাসের শুরু থেকেই নারীরা নানা রকমের সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন। নারী-ভ্রূণ হত্যা থেকে শুরু হয় এই সহিংসতার ধারাবাহিকতা। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নানাভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা চলছে। ডব্লিউএইচওর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের প্রায় ৩১ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার হন। ধর্ষণ, পাচার, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্তকরণসহ নানাভাবে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
নারী-পুরুষের জীবনমানের সুষম উন্নয়ন প্রগতির একটি অনিবার্য শর্ত। অথচ বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে। সরকারি হিসাবেই বাংলাদেশের ৭২.৬ শতাংশ নারী পরিবারে স্বামী বা ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক কিংবা কর্মক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন। বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফোরাম (এমএসএফ) মনে করে, দেশে নারীদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা যে হারে ঘটে চলেছে, তাতে করে সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও জোরদার হওয়া জরুরি।
ইসলাম নারীর অধিকার সমুন্নত করেছে। প্রাক-ইসলামি যুগে যখন নারীর কোনো সামাজিক অধিকার ছিল না, নবজাত কন্যাশিশুকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো এবং পুরুষেরা নারীকে শুধু ভোগের জন্য ব্যবহার করত, তখন মহানবী (সা.) সৎকর্মে নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা এবং সমাজে নারীর বেঁচে থাকার অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে কালজয়ী দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করো না।’ (সুরা আনআম: ১৫১)
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ‘সেদিন (কেয়ামতের দিন) জীবন্ত প্রোথিত কন্যাদের জিজ্ঞাসা করা হবে—কোন্ অপরাধে তাদের হত্যা করা হয়েছিল।’ (সুরা তাকভির: ৮-৯)
আরও এরশাদ হয়েছে, ‘পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে যারাই সৎকাজ করবে এবং ইমানদার হবে, তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও জুলুম করা হবে না।’ (সুরা নিসা: ১২৪)
ইসলামের দৃষ্টিতে যেকোনো ধরনের জুলুম-নির্যাতনই হারাম। আর তা যদি হয় নারী নির্যাতন, তবে তা আরও গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ। শুধু এটুকুই নয়, নির্যাতনের পক্ষে সহায়ক সব ধরনের উপকরণ-উপাদানও ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ আল্লাহর অত্যন্ত সম্মানিত সৃষ্টি। মানুষই সৃষ্টিজগতের সেরা জীব। আর নারী মানবসমাজের গর্বিত অংশীদার। ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কেই জন্মগতভাবে মর্যাদা দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি। তাদের জন্য জলে-স্থলে যানবাহনের ব্যবস্থা করেছি। তাদের পবিত্র রিজিক দিয়েছি। আর আমার অধিকাংশ সৃষ্টির মধ্যে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরিয়েছি।’ (সুরা ইসরা: ৭০)
নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। সুষ্ঠু-সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান অনস্বীকার্য। ইসলামের বিধিবিধান পালনের ক্ষেত্রেও নারীর রয়েছে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদ।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭)
আরও এরশাদ হয়েছে, ‘বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের যেমন অংশ রয়েছে, নারীরও তেমন অংশ রয়েছে। কমবেশি যাই হোক এ অংশ নির্ধারিত।’ (সুরা নিসা: ৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কাজের আদেশ দেয়, মন্দ কাজে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। তাদের প্রতিই আল্লাহ করুণা প্রদর্শন করবেন। আল্লাহ তো প্রবল পরাক্রমশালী, মহা প্রজ্ঞাবান।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ৭১)
মুসলিম নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসলাম পর্দা ও শালীনতার শিক্ষা দিয়েছে। অত্যাচার, অপমান ও লাঞ্ছনার পরিবেশ থেকে রক্ষা করতে মায়ের মর্যাদা দিয়েছে। ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে। কন্যাসন্তানের লালনপালনকে আলাদাভাবে মহিমান্বিত করেছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যার তিনটি কন্যা বা তিনটি বোন আছে, আর সে তাদের আদর, সোহাগ ও উত্তম শিক্ষা দিয়ে সুপাত্রে বিয়ে দিয়েছে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত। তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম যে (সদাচারে) তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি)
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তির কন্যাসন্তান আছে, আর সে তাকে জ্যান্ত সমাহিত করেনি কিংবা তার সঙ্গে লাঞ্ছনাকর আচরণ করেনি এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর অগ্রাধিকার দেয়নি, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (আবু দাউদ)
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য মহানবী (সা.) সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সমাজের চোখে অবহেলিত গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত নারীদের প্রতিও সদয় আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘দাসদাসীদের ব্যাপারে সাবধান হও! তোমরা যা খাবে তাদের তা খেতে দেবে এবং তোমরা যা পরবে তাদের তা পরতে দেবে।’ (আহমাদ)
জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও মহানবী (সা.) নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন। বিদায় হজের ভাষণে লাখো মানুষের সামনে নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে মানুষ, নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করো না। তাদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের কল্যাণের দিকে সব সময় খেয়াল রেখো।’
নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে পবিত্র কোরআনের সুরা নুর-এ আল্লাহ তাআলা যে সুন্দরতম সামাজিক বিধিবিধান দিয়েছেন, তা অত্যন্ত কার্যকর ও ফলপ্রসূ। ইসলামি বিধানের অপব্যাখ্যা করে নারীকে তুচ্ছ, অবহেলা বা লোভ-ক্ষোভের পাত্র বানানো থেকে বিরত থাকতে হলে প্রয়োজন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের সঠিক প্রয়োগ। নারীরা পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী নন বরং সহযোগী—এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে পারলে এবং রাষ্ট্রীয় আইন ও ইসলামি বিধিবিধান পালন করতে পারলে মানবজীবন ভারসাম্যপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত করা সম্ভব।
কাজী ফারজানা আফরীন: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়