পর্যটন, লবণ, চিংড়ি ও কৃষিপণ্যসহ নানা কারণে গুরুত্ব বেড়েছে পর্যটন শহর কক্সবাজারের। তাই কক্সবাজারের সাথে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজ করণ এখন সময়ের দাবী। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশের অর্থনীতিতে। উন্নত জীবন ও যত্নশীল জীবনে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণের বিকল্প নেই। কক্সবাজারে রেললাইন চালু হলে পর্যটকদের পাশাপাশি ঘুরে যাবে
কক্সবাজার অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকাও। এই গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে
দেহাজারী-কক্সবাজার ১০০ কিমি রেল পথের ৭৪ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন কক্সবাজারবাসী আশা করছেন দ্রুতই ট্রেন আসবে কক্সবাজারে।
জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই ট্রেন আসছে পর্যটননগরী কক্সবাজারে। এই টার্গেট নিয়েই কাজ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে ৫০ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন এখন দৃশ্যমান। এরই মধ্যে এই মেগা প্রকল্পের কাজ ৭৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি প্রকল্প কর্মকর্তাদের। বাকি ২৪ শতাংশ কাজ দ্রুত শেষ করে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল শুরু করতে পারবেন বলে তারা আশাবাদী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ চালু হলে শুধু পর্যটন খাতে সম্ভাবনা বাড়বে তা নয় লবণ, মৎস্য, কৃষিসহ অন্যান্য খাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেল
পথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে।
তবে মিয়ানমার সরকারের সম্মতি না থাকায় আপাতত রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ হচ্ছে না।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১০০ কিলোমিটার রেলপথে স্টেশন থাকছে আটটি। এগুলো হলো- সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদর ও উখিয়া। এ জন্য সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি বড় সেতু। এ ছাড়া এই রেলপথে নির্মাণ করা হচ্ছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট ও ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে একটি ফ্লাইওভার, রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দু’টি হাইওয়ে ক্রসিং। হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচলে ৫০ মিটারের একটি ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমানের মতে ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৫০ কিলোমিটারের বেশি এখন দৃশ্যমান। বেশির ভাগ ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। যেগুলো বাকি আছে সেগুলো আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ হবে। অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। আমরা চেষ্টা করছি ২০২৩ সালের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে। একই সাথে রেলস্টেশনগুলোর নির্মাণকাজও চলমান আছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে রেল গেজ ও সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
এদিকে, কক্সবাজার সদর থেকে সাত কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান আছে। নির্মাণাধীন আইকনিক ভবন ঘেঁষে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। এর পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের কাজ, শেষ পর্যায়ে। স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা যাওয়া করতে পারবেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দাবি করেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি, নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে। এরপরও কাজ চলছে। একইভাবে সাগরপথে জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় অন্য দেশ থেকে মালামাল আনতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
এদিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুর পাশে আরেকটি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হবে। নতুন সেতুটি হবে পদ্মা সেতুর আদলে। এই সেতু নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে ৭৮০ মিটার। আর সেতুর উচ্চতা হবে ১২ দশমিক দুই মিটার। সেতুর ওপরে গাড়ি চলবে, নিচে দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুটি নির্মাণে সব ব্যয় বহন করবে কোরিয়ান সরকার। শিগগিরই এই সেতুর কাজ উদ্বোধন করা হবে।
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. মোঃল এখলাছ উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেললাইন চালু হলে অবশ্যই এলাকার কৃষিতে পরিবর্তন আসবে। ট্রেনে কম টাকায় কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ সহজে পরিবহন করা যাবে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।’