বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দেশ টিভির পরিচালক আরিফ হাসান। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা কানাডায় পাচার করেও কোনো রহস্যময় কারণে তিনি এতোদিন ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অবশেষে গত ১৭ নভেম্বর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে কানাডা পালিয়ে আসার সময় ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।
দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আরিফ হাসান ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেছেন। দুদকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আরিফ হাসানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে তার মালিকাধীন হাসান টেলিকমের ৩৩৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া আরিফ হাসান, তার স্ত্রী এমিলি ফয়েজের নামে কানাডার টরন্টোর একটি বাড়ি কেনার তথ্য অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। জাল-জালিয়াতি করে আয় করা টাকায় বাড়িটি কেনা হয়েছে। এর পাশাপাশি আরিফ হাসান ও তার বাবা আবদুল আজিজের নামে ১২৮ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।’
কে এই আরিফ হাসান?
আরিফ হাসানের জন্মস্থান কুমিল্লা। তার বাবার নাম আবদুল আজিজ এবং মায়ের নাম মালেকা পারভীন। ঠিকানা দু’টি হলো বাড়ি-১৮/এ, রোড-৪৪, গুলশান উত্তর, ঢাকা-১২১২ এবং অ্যাপার্টমেন্ট-বি-৩/ডি, বাসা-১৫, পুরাতন ডিওএইচএস, বনানী। পাসপোর্টে আরিফের জন্ম তারিখ হলো ১৯৭৪ সালে ২৭ জুন। তিনি যে পাসপোর্ট ব্যবহার করে কানাডা সফর করেন সেটির ইস্যুর তারিখ হলো ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর। দুদক সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬ বার পাসপোর্ট পরিবর্তন করা আরিফ হাসানের জাল-জালিয়াতির আরও অনেক তথ্য আছে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর দুদক থেকে আরিফের মামলার বিষয়টি আর জানা যাচ্ছে না। কারন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এখন তোপের মুখে।
আরিফের ঋণ জালিয়াতি:
ন্যাশনাল ব্যাংক মহাখালী শাখায় আরিফের মালিকাধীন হাসান টেলিকমের নামে ২৭৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। ডাইরেক্ট হু হোম প্রকল্পের আওতায় ৪৭৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ওয়ার্ক পারমিটের বিপরীতে ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ঋণের আবেদন করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর ব্যাংকের পর্ষদ সভায় হাসান টেলিকমের অনুকূলে ২৭৫ কোটি টাকার ৫ বছর মেয়াদি ওভারড্রাফট (ওডি) ঋণ অনুমোদন করা হয়। ২৯ নভেম্বর আরিফের ব্যাংক হিসাবে ১০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে পুরো টাকা ১৯টি চেকের মাধ্যমে তুলে নেন আরিফ। ২ ও ৩ ডিসেম্বর যথাক্রমে ১০০ কোটি ও ৭৫ কোটি টাকা একইভাবে আরিফের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে চেকের মাধ্যমে ওই টাকাও তুলে নেন আরিফ।
দুদক বলছে, আরিফের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ভি-৮ গাড়িটি বাংলাদেশে খুব বেশি ব্যবহার হয় না। এর আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকা। গত বছর তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হলে গাড়িটি লুকিয়ে ফেলেন আরিফ। গাড়িটির নম্বরের সূত্র ধরে দুদক জানতে পেরেছে নিজের টাকায় কেনা হলেও রেজিস্ট্রেশন অন্যের নামে করেছেন আরিফ। গাড়িটি বর্তমানে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২১ নতুন বিনিয়োগকারী হিসেবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বান্ধবী তৌফিকা আফতাবকে নির্বাহী চেয়ারম্যান করা হয়। দুদকের মামলা স্থগিত এবং আদালতের নির্দেশে ফ্রিজ থাকা ১৫ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সচল করার শর্তে নাকি তৌফিকাকে চেয়ারম্যান পদটি দেওয়া হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তৌফিকা লাপাত্তা হয়ে গেলে নির্বাহী পরিচালক এবং চেয়ারম্যান দুটি পদই আরিফ হাসানের দখলে চলে যায়।
টরন্টোতে আরিফের বাড়ি কেনার কাহিনী
আরিফ হাসান কানাডার অভিজাত এলাকায় যে বাড়িটি কিনেছেন তা বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে কেনা বলে দুদক জানিয়েছে।
বাড়ি কেনার নথির তথ্য: ২০০০ সালের ৮ মে থেকে ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরিফ হাসানের কেনা বাড়িটি হাত বদল হয় চারবার। সর্বশেষ হাত বদলে বাড়ির মালিক হন আরিফ। নথির তথ্য অনুযায়ী, বৃহত্তর টরন্টোর নর্থ ইয়র্কের ৮২ হলিউড এভিনিউর এ বাড়িটি গেল বছরের সেপ্টেম্বরে আরিফ হাসান টরন্টোতে উপস্থিত থেকেকেনেন। পরে পুরনো বাড়ি সংস্কার করে নতুন রূপ দেন। সংস্কার করে বাড়িটির নতুন রূপ দিতে আরিফ হাসান খরচ করেছেন ১ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার। বাড়ি বেচাকেনার লিস্টিংয়ের (নথিভুক্ত) বাইরে প্রাইভেট ডিলিংয়ের (ব্যক্তিগত যোগাযোগ) মাধ্যমে নগদ অর্থে বাড়িটি কেনা হয়েছে।২০০০ সালের ৮ মে বাড়িটি কিনেছিলেন মারিয়া লার্চ ও অগাস্ট লার্চ নামে দুই ব্যক্তি। ৩ লাখ ৫৮ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কিনেছিলেন তারা। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারা বাড়িটি বিক্রি করে দেন। ক্রেতা ছিলেন জরা ইজাদিয়ান। ২৪ লাখ কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন তিনি। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জরা ইজাদিয়ানও বাড়িটি বিক্রি করেন। এবার বাড়ির ক্রেতা ছিলেন রাফে নাদের। ২৫ লাখ ৫৫ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন তিনি। সর্বশেষ বাড়িটি হাত বদল হয় ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। রাফে নাদেরের কাছ থেকে ৩৬ লাখ ৫০ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন দেশ টিভির পরিচালক আরিফ হাসান। বাড়ির মালিকানায় আরও দু’জনের নাম আছে। তারা হলেন আরিফ হাসানের স্ত্রী এমিলি ফয়েজ ও সুফিয়া চৌধুরী নামে অন্য এক মহিলা।
৬ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গার ওপর আরিফ হাসানের বাড়িটির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৩ কোটি ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৯৮২ টাকা। আর সংস্কার বাবদ খরচ হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৪৩ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৭ টাকা। তবে এ বাড়িতে থাকেন না আরিফের পরিবার। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় আরিফ দেশে থাকলেও তার স্ত্রী এমিলি ফয়েজ থাকছেন টরন্টোতেই। অন্য একটি বাড়িতে তারা আত্মগোপন করে রয়েছেন বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
অবশেষে
গত ১৭ নভেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে দেশ ত্যাগের সময় ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয় আরিফ হাসানকে।