ঢাকা, ১১ এপ্রিল – দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের নেওয়া নানা কর্মসূচির কারণে দেশে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের হার কমেছে। দেশে এখন দরিদ্র জনগোষ্ঠী ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া হতদরিদ্রের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ওই বছর হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। ফলে সাত বছরের ব্যবধানে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সময়ে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী কমেছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
দারিদ্র্যের হার নির্ধারণে কাজ করা সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে এমন তথ্য জানা গেছে। ২০১৬ সালের পর এ সম্পর্কিত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি বিবিএস। সংস্থাটির সর্বশেষ ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১৬’প্রকাশ করেছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এইচআইইএস-২০২২ এর কি ফাইন্ডিংসে দেখা যায়, কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে দেশে দারিদ্র্য হ্রাসের এই চিত্র অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে। দারিদ্র্যের হার বের করা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দারিদ্র্য পরিমাপ ও বিশ্লেষণে প্রযুক্তিগত সহায়তাও দিয়েছে সংস্থাটি।
বুধবার (১২ এপ্রিল) আনুষ্ঠানিকভাবে এইচআইইএস-২০২২ এর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করবে বিবিএস।
সারা দেশের ৭২০টি নমুনা এলাকায় এই জরিপ পরিচালিত হয়। প্রতিটি নমুনা এলাকা থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ২০টি করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপের প্রশ্নপত্রে মোট ১০টি সেকশন রয়েছে। এই ১০টি সেকশনের তথ্য সংগ্রহের জন্য একজন তথ্য সংগ্রহকারী প্রতিটি খানায় ১০ বার ভিজিট করেন।
জরিপ পরিচালনার সময়কাল
হেইজ ২০২২ জরিপে ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে শুরু হয়ে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ সময়ে অর্থাৎ এক বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
তবে বিবিএসের তথ্য নিয়ে বিতর্ক আছে দাবি করে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কত সেটা বিতর্কের বিষয়। সরকার বলছে দারিদ্র্য কমে গেছে। তবে সানেম (বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) বলছে বেড়েছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে তা দারিদ্র্য ঘনীভূত করে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এতে দারিদ্র্য বেড়ে যায়। সুতরাং বিবিএসের রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বিবিএস জানায়, বাংলাদেশে দারিদ্র্য, আয়-ব্যয়, ভোগ সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদানের জন্য একটি স্বতন্ত্র জরিপ হলো এইচআইইএস। এটি আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, অভিবাসন এবং রেমিট্যান্স ইত্যাদি বিষয়েও তথ্য সরবরাহ করে। বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সালে হাউজহোল্ট এক্সপেনডিচার সার্ভে নামে এ জরিপটি প্রথম পরিচালনা করা হয়। সর্বশেষ ১৬তম রাউন্ড হিসেবে হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে নামে ২০১৬-১৭ সালে পরিচালিত হয়। ২০১৬-১৭ সালের পরে দারিদ্র্যের কোনো জরিপভিত্তিক তথ্য না থাকায় ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়ে দারিদ্র্য বৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতার ওপর ভিত্তি করে কিছু দারিদ্র্যের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
এ অবস্থায় জরিপের মাধ্যমে হালনাগাদ দারিদ্র্য পরিসংখ্যান প্রস্তুত করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। বিবিএস পরিচালিত হেইজ-২০২২ জরিপে ২০২২ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরব্যাপী সংগৃহীত রিয়েল টাইম ডেটা থেকে জাতীয় এবং বিভাগীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। এটি ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতি পরিবীক্ষণের পাশাপাশি এসডিজি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পরিবীক্ষণে জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
২০৩১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশ একটি মডেল দেশে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তার সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের দারিদ্র্য নিরসনের কৌশলে বাংলাদেশকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
বিবিএস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের বাস্তবসম্মত হস্তক্ষেপের ফলে দারিদ্র্য কমেছে। সোশ্যাল সিকিউরিটি প্রোগ্রাম (এসএসপি) যেমন- বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা, দরিদ্রদের জন্য আয়বর্ধক কর্মসূচি, আশ্রয়ন প্রকল্প, কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি ইত্যাদি দারিদ্র্য কমাতে অবদান রেখেছে। ভবিষ্যতেও এসব কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এসব কর্মসূচির অধীনে প্রকৃত যোগ্য সুবিধাভোগী নির্বাচনের জন্য টার্গেটিং মেকানিজমকেও পরিশীলিত করা হবে। হেইজ থেকে প্রাপ্ত দারিদ্র্য সংক্রান্ত তথ্য বিভিন্ন এসএসপি প্রোগ্রামের অধীনে দরিদ্রদের সঠিক টার্গেটিং করতে সাহায্য করবে।
নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে দরিদ্র ও হতদরিদ্র কমেছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সার্বিকভাবে ১৯৯০ সাল থেকে দেশে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। সেই উন্নতির সুবিধা পাওয়া গেছে। শিল্প কারখানার প্রসার ঘটেছে। ফলে দারিদ্র্যের হার কমেছে। হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের কিছু কর্মসূচি আছে। তবে এটা টেকসই নয়। যে কারণে মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে হতদারিদ্র জনগোষ্ঠী কষ্ট পায়। তবে যে হারে দারিদ্র্য কমার দরকার তা কমছে না। উন্নয়নের ফল সবার কাছে সঠিকভাবে পৌঁছায়নি, ভগ্নাংশ পৌঁছায় মাত্র।
বিবিএসের তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি
ক্যাফি (কম্পিউটার অ্যাসিসটেড ফিল্ড এন্ট্রি) পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের পরিবর্তে এবছর ক্যাপি (কম্পিউটার অ্যাসিসটেড পারসোনাল ইন্টারভিউইং) পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের ওজন সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য তথ্যসংগ্রহকারী ওয়েট স্কেল ব্যবহার করেছে।
খানা/পরিবারের খাদ্যদ্রব্যের ও খাদ্যবহির্ভূত দ্রব্য ও সেবার তালিকা সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রতিটি খানা/পরিবারের জন্য একটি করে ডায়েরি দেওয়া হয়।
প্রশ্নপত্রে নতুন করে ভোগকৃত খাদ্যদ্রব্য এবং খাদ্যবহির্ভূত দ্রব্য ও সেবার তালিকা আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০১৬ সালে খাদ্যদ্রব্যের সংখ্যা ছিল ১৪৯টি, যা ২০২২ সালে বাড়িয়ে ২৬৩টি করা হয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত দ্রব্য ও সেবার সংখ্যা ছিল ২১৬টি, যা ২০২২ সালে বাড়িয়ে ৪৪১টি করা হয়েছে। এসডিজির আলোকে প্রশ্নপত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হয়েছ। যেমন- স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রশ্ন, মাতৃত্ব ও শিশুমৃত্যু সংক্রান্ত প্রশ্ন, ব্যাংক হিসাবের গ্রাহক, মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তথ্য সংবলিত প্রশ্ন ও পিতা-মাতার শিক্ষাগ্রহণের সংযোগ নির্ণয়ের জন্য নতুন প্রশ্ন যোগ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ ও এর টিকা সংক্রান্ত প্রশ্ন সংযোজন করা হয়েছে। খানা/পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার প্রশ্ন সংবলিত নতুন সেকশন যোগ করা হয়েছে।
প্রশিক্ষণ
তথ্যসংগ্রহকারীদের তিন সপ্তাহব্যাপী আবাসিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ২২-২৪ মার্চ ১ম রিফ্রেশার প্রশিক্ষণ ও ২৮-৩০ আগস্ট দ্বিতীয় রিফ্রেশার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
তথ্যসংগ্রহ কার্যক্রম মনিটরিং
এবছর তথ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে জোরদার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায় জরিপের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ঢাকার সবুজবাগ এলাকায় জরিপের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. মো. কাউসার আহাম্মদ ঢাকার আদাবর এলাকায় জরিপের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। পাশাপাশি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মাঠ পর্যায়ের (বিভাগ, জেলা ও উপজেলা) কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক তথ্যসংগ্রহ কার্যক্রম মনিটরিং করেছেন।
প্রতিদিনের সংগৃহীত তথ্যের গুণগত মান যাচাই ও তাৎক্ষণিক করণীয় নির্ধারণে/ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে আট বিভাগের জন্য ৮ জন ডাটা এন্ট্রি মনিটরিং সুপারভাইজার নিয়োজিত ছিল।
দারিদ্র্য পরিসংখ্যানের ঐতিহাসিক পটভূমি
বিশ্বে খানার ব্যয় জরিপের মাধ্যমে দারিদ্র্য পরিসংখ্যান প্রণয়নের ইতিহাস প্রায় ১৬৫ বছরের পুরোনো। ১৮৫৭ সালে জার্মান পরিসংখ্যানবিদ আরস্ট অ্যাঞ্জেল বেলজিয়ামের সমজাতীয় প্রায় ১৫৩টি পরিবারের (খানা) ওপর তাদের খাবারের স্বাদ ও মূল্য সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি ওই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিবারসমূহের আয় ও খাদ্য ক্রয়ে শতকরা পরিমাণ বিষয়ক একটি থিওরি প্রদান করেন, যা অ্যাঞ্জেল কার্ভ হিসেবে পরিচিত। পরে ১৯০১ সালে ইংল্যান্ড শহর এলাকায় শ্রমিক পরিবারের আয়ের ওপর বিট্রিশ বোর্ড অব ট্রেড একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। জাপান প্রথম ১৯২৫ সালে প্রায় ৪ হাজার ৭৮৫টি খানায় ফ্যামিলি বাজেট সার্ভে পরিচালনা করে।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিসংখ্যান
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থাগুলোর অন্যতম কাজের একটি হলো পোভার্টি স্ট্যাটিসটিকস প্রকাশ করার লক্ষ্যে জরিপ পরিচালনা করা। বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে করা হয়। কোথাও হেইজ নামে, আবার কোথাও ফ্যামিলি বাজেট সার্ভে নামে পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশে প্রথম দিকে এটি হাউজহোল্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে নামে পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে নামে জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭৩-৭৪ সালে হাউজহোল্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে করা হয়েছিল। এরপর ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গুরুত্বপূর্ণ এ জরিপটি নিয়মিত বিরতিতে পরিচালনা করে আসছে। বিবিএস এ পর্যন্ত মোট ১৭ রাউন্ড হেইজ পরিচালনা করেছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে বিবিএস ১৭তম রাউন্ড হেইজ পরিচালনা করে।
জরিপের উদ্দেশ্য
দারিদ্র্য দূরীকরণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ পরিবীক্ষণে উপাত্ত সংগ্রহ। এ লক্ষ্যে দারিদ্র্য পরিসংখ্যান ও এ সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করা হয়।
সূত্র : জাগো নিউজ
এন এ/ ১১ এপ্রিল