সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫, ০৮:০৪ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

কানাডার আসন্ন ফেডারেল নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫




কানাডা একটি সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দেশ। আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ, ভোটারদের অংশগ্রহণ, বিভিন্ন ইস্যু এবং সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনার ঝড় বইছে। তারই আলোকে আমার এ লেখা।

কানাডা একটি সংসদীয় গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দেশ। প্রতি নির্বাচনে আমরা যেন নতুন করে বুঝি জনগণের আশা-আকাঙ্খা কতটা পরিবর্তনশীল এবং রাজনীতির ভাষা কতটা বিবর্তিত। ২০২৫ সালের আসন্ন ফেডারেল নির্বাচন এই পরিবর্তনের এক অনন্য মঞ্চ, যেখানে পুরনো ও নতুন প্রজন্ম, মূলধারার রাজনীতি ও বিকল্প চিন্তাধারা, বৈশ্বিক চাপ ও স্থানীয় স্বার্থ একে অপরের মুখোমুখি।

২০২৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনটি একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার চাপ, আবাসন সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং তরুণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যেই ভোট গ্রহণ হবে। সদ্য মনোনীত প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি তাঁর প্রথম নির্বাচন মোকাবেলা করছেন।

কানাডার নির্বাচনে ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভোটারদের অংশগ্রহণের ধরন, আগ্রহ ও প্রভাবশক্তি নাটকীয়ভাবে বদলেছে। তিনটি গোষ্ঠী—তরুণ, নারী এবং অভিবাসী ভোটার—বর্তমান সময়ে নির্বাচনী ফলাফলে নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠেছে।

তরুণ ভোটার:
১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ভোটাররা এক সময়ে ভোটদানে অনাগ্রহী থাকলেও, এখন তারাই পরিবেশ, প্রযুক্তি, উচ্চশিক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ইস্যুতে সবচেয়ে সরব। সামাজিক মাধ্যম তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়িয়েছে এবং অনেক তরুণ এখন ভোটাধিকারকে পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। তরুণ প্রার্থীদের উত্থান, যেমন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্বাচন-প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তরুণদের মধ্যে নতুন করে রাজনৈতিক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।

এই তিন শ্রেণির ভোটারদের অংশগ্রহণ নির্বাচনকে আরও বর্ণময়, ন্যায়নির্ভর এবং ভবিষ্যতমুখী করে তুলেছে।

বর্তমান নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে জনমতের কেন্দ্রে উঠে এসেছে পাঁচটি মুখ্য ইস্যু—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিবাসন। প্রতিটি ইস্যু রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।

শিক্ষা:
কানাডার তরুণ ভোটারদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুগুলোর একটি হচ্ছে শিক্ষা।বিশ্ববিদ্যালয় ফি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপর প্রবল চাপ তৈরি করছে। ছাত্র ঋণের বোঝা অনেককে চাকরিজীবনের শুরুতেই হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। লিবারেল ও এনডিপি উভয় দলই ছাত্র ঋণ মওকুফ, টিউশন ফি হ্রাস এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কনজারভেটিভ দল যদিও এই বিষয়ে সরাসরি আর্থিক সহায়তার কথা কম বলেছে, তবে তারা কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।

স্বাস্থ্য:
কানাডার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিনামূল্যে হলেও, হাসপাতালের দীর্ঘ অপেক্ষার সময়, পারিবারিক চিকিৎসকের অভাব এবং মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার সংকট জনগণের ক্ষোভের কারণ। মহামারির পর থেকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকট হয়েছে। এনডিপি এই সেক্টরে আরও বিনিয়োগের কথা বলেছে, বিনামূল্যে ওষুধ ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লিবারেল পার্টিও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্প্রসারণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে কনজারভেটিভ দল বরাবরের মতো খরচ নিয়ন্ত্রণ ও প্রদেশগুলোর ওপর দায়িত্ব আরোপের পক্ষপাতী।

জলবায়ু পরিবর্তন:
বনাঞ্চল ধ্বংস, দাবানল, খরা, বন্যা এবং আবহাওয়ার চরম রূপ কানাডাকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ভোটারদের একটি বড় অংশ পরিবেশবান্ধব নীতির পক্ষে। লিবারেল দল কার্বন ট্যাক্স ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের কথা বলেছে। এনডিপি ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চায়। কনজারভেটিভরা কার্বন ট্যাক্সের বিরোধিতা করছে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় ‘বাজারভিত্তিক’ সমাধানের কথা বলছে, যা অনেকের কাছেই অপ্রতুল মনে হয়েছে।

ইমিগ্রেশন:
কানাডা এক বহুজাতিক রাষ্ট্র, যার ভিত্তি গড়ে উঠেছে অভিবাসনের ওপর। তবে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চাপ, চাকরির প্রতিযোগিতা ও আবাসন সংকট অভিবাসন নীতিকে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। একদিকে, মানবিকতা ও আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালনের তাগিদ; অন্যদিকে, কড়াকড়ি আর সীমান্তনিয়ন্ত্রণের ডাক। কনজারভেটিভ দল অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও ‘যোগ্যতা-নির্ভর’ করার কথা বলছে, যেখানে লিবারেল দল বহুত্ববাদ ও শরণার্থী সহায়তার প্রতিশ্রুতি বজায় রাখছে। এনডিপি আরও মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক অভিবাসন ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব:
ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য নীতি ও উস্কানিমূলক ভাষণ, বিশেষ করে কানাডাকে ৫১তম রাজ্য বলার মত মন্তব্য, কানাডিয়ানদের মধ্যে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। লিবারেলরা ট্রাম্পবিরোধী অবস্থান নিলেও কনজারভেটিভরা কখনোই প্রকাশ্যে তার নীতির বিরোধিতা করেনি।

দুর্নীতি ও মনোনয়নপ্রক্রিয়া:
কানাডার রাজনৈতিক দলগুলো স্বচ্ছতা বজায় রাখার দাবি করলেও সময়ে সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ঘুষ দিয়ে মনোনয়ন কেনা, দলীয় তহবিলের অপব্যবহার, নির্বাচনী প্রচারণায় বিধি লঙ্ঘন এই সব অভিযোগ অনেক সময় দলীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করে। তবে ইলেকশন কমিশন কঠোর অবস্থানে থাকে এবং অভিযুক্তদের শাস্তি হতে পারে মনোনয়ন বাতিল, জরিমানা বা রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।

২০২৫ সালের এই নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং এটি কানাডার ভবিষ্যতের জন্য একটি দিকনির্দেশক মুহূর্ত। জনগণের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে এমন একজন নেতা বা দলকে নির্বাচিত করা, যারা সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে। তরুণ, অভিবাসী, নারী—সবাই যেন তাদের কণ্ঠস্বরকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো প্রার্থীকে খুঁজে পায়।

নির্বাচন মানেই শুধু ভোট নয়—এটি একটি মূল্যবোধ, নীতিমালা ও ভবিষ্যৎ ভাবনার প্রতিচ্ছবি। তাই আসুন, যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সহানুভূতিশীল এবং অগ্রসর কানাডা গড়ে তুলি।



আরো খবর: