বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

কক্সবাজার পথে জয়যাত্রা পদ্মা নদী পাড়ি দিল রেল

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: বুধবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৪

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে সারাবিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, যোগাযোগ, ব্যবসাবাণিজ্য ও নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সরকারের ১০টি বৃহৎ প্রকল্পের সুফল নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন-

দেব দুলাল মিত্র : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী চিন্তার সফল বাস্তবায়ন দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। গত ১১ নভেম্বর বহুল প্রতীক্ষিত ১০১ কলোমিটার এই রেলপথের উদ্বোধন করা হয়েছে। ভ্রমণ পিপাসুরা এখন কোনো ধরনের বিড়ম্বনা ছাড়াই কম সময়ে ট্রেনে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যেতে পারছেন। এর ফলে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার রেল সংযোগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই প্রকল্পটিও শেখ হাসিনা সরকারের একটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ প্রকল্প। রেললাইন স্থাপনের পাশাপাশি কক্সবাজারে দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ শেখ হাসিনার আরো একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। দুইটি প্রকল্পই উদ্বোধন হওয়ায় জনগন এর সুফল পাচ্ছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় সরকারগুলো নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করলেও এক ইঞ্চি পরিমান রেললাইন স্থাপন করা হয়নি। শেখ হাসিনাই রেল সম্প্রসারণে প্রথম উদ্যোগ নেন। কক্সবাজার থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণেও শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু মিয়ানমারের আপত্তির কারণে এই রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। শেখ হাসিনার

নির্দেশে ২০৪৫ সালের মধ্যে দেশের ৬০টি জেলায় রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে কাজ করছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা যে কোনো দেশের উন্নয়নের পূর্ব শর্ত। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ সহজে যোগাযোগ করতে পারছে। এছাড়া বরিশাল অঞ্চলের এক বিশাল জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে রেল যোগাযোগের আওতায় আসতে পারবে। পায়রা বন্দর হওয়ায় বন্দরের সঙ্গে মালামাল সহজে আনানেয়ার জন্যও রেল যোগাযোগ বড় ভূমিকা রাখবে। অপরদিকে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় দেশের সব মানুষ উপকৃত হবে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে শেখ হাসিনা সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়নের পাশাপাশি রেল যোগাযোগ উন্নত ও সহজ করতে নানামুখী প্রকল্প হাতে নেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পটি ছিল অন্যতম। ২০১০ সালে সরকার এই প্রকল্পটি হাতে নেয়। প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প সংশোধনের প্রয়োজন হয়। ২০১৬ সালে প্রকল্প সংশোধন করা হলে ব্যয় বেড়ে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল প্রকল্প সংশোধনী একনেকে পাস হয়। এর মধ্যে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে কাজেই খরচ ধরা হয় ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রথমে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী সময় ২০২২ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২৩ সালে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার পর দোহাজারী-কক্সবাজার নতুন রুটে রেল যোগাযোগ শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের রেলপথ সিঙ্গেল লাইন মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই রেলপথ ভবিষ্যতে ট্রান্স এশীয় রেলপথের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হলে ব্রডগেজ রেলপথের প্রয়োজন হবে। এ কারণে ব্রডগেজ রেললাইনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরফলে এই রেলপথে উভয় ধরনের রেল চলাচল করতে পারবে।
চারটি প্রতিষ্ঠান এই রেলপথ নির্মাণের কাজ করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। দুইটি লটে ভাগ করে পুরো প্রকল্পের কাজ করা হয়। এর একটি লটে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের চকরিয়া পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার এবং অপর লটটি হচ্ছে চকরিয়া থেকে কক্সবাজার রেলস্টেশন পর্যন্ত রেলপথ।
এই প্রকল্পটি সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই প্রকল্পের অংশ হিসাবে পর্যটন শহর কক্সবাজারে একটি আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু এই রেলস্টেশনটি নির্মাণেই ব্যয় হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণে ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ৯টি রেলস্টেশন নির্মিত হয়েছে। স্টেশনগুলো হলো চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া, কক্সবাজারের চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ঈদগাহ, রামু, সদর ও উখিয়া। ভবিষ্যতে রামু থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেল যোগাযোগ স্থাপন করা হলে সেখানে ১টি রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের আওতায় রেলপথের বিভিন্ন স্থানে ৪টি বড় সেতুসহ ৩৯টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। মাতামুহুরী, ছোট মাতামুহুরী, শঙ্খ ও বাঁকখালী নদীর ওপর বড় ৪টি সেতু নির্মাণ করা হয়।
পদ্ম সেতুতে রেল সংযোগ : অপরদিকে পদ্ম সেতুতে রেল সংযোগ স্থাপন হওয়ায় দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী হয়েছে। এই প্রকল্পটি শেখ হাসিনার আরো একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফসল। গত ১০ অক্টোবর শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এইদিন তিনি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া রেলস্টেশন থেকে যাত্রী হয়ে ট্রেনে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ভাঙ্গায় পৌঁছেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্ম সেতুর প্রকল্পের মূল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। এরসঙ্গেই পদ্মা সেতুতে রেল চলাচল চালু নিয়েও সরকার পদক্ষেপ নেন। ২০১৬ সালের ৩ মে একনেক সভায় পদ্মা সেতুর ওপর রেললাইন স্থাপনে ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এই প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ১৬৯ কিলোমিটার। এই পথে ঢাকা থেকে যশোরের সঙ্গে কম সময়ে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এরমধ্যে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধন করা হয়। গত ১০ অক্টোবর শেখ হাসিনা এই অংশের রেল চলাচল উদ্বোধন করেন। ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণ প্রকল্পের’ আওতায় ঢাকা ও যশোরের মধ্যে রেল সংযোগ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০২৪ সালের শেষ দিকে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত আরো ৮৭ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধন করা হবে। এই অংশে বেশ জোরেসোরেই প্রকল্পের কাজ চলছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এতে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই রেল সংযোগে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ১৬৯ কিলোমিটার। ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথে মূল লাইনের সঙ্গে লুপ ও সাইডিং লাইন থাকছে ৪২ দশমিক ২২ কিলোমিটার। ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইনসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এই পুরো পথে থাকবে মোট ২০টি স্টেশন। এই স্টেশনগুলোর মধ্যে ১৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি ৬টি স্টেশন আগে থেকেই ছিল। পুরাতন স্টেশনগুলোর আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে রেল যোগাযোগ পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ পথ আরো বাড়বে। এর ফলে রেল সংযোগের বাইরে থাকা মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলায় রেল সংযোগ স্থাপিত হবে।


আরো খবর: