প্রতিদিন বহির্বিভাগে আটটা বাজতে বাজতে একটা লম্বা লাইন তৈরি হয় । একটু পর একটা লাইন থেকে বাড়তে বাড়তে দুইটা তিনটা হয়ে যায় । মাঝে মাঝে বাইরেও লাইন চলে যায়। বয়স্ক মানুষ, গর্ভবতী মা, ছোটছোট শিশু সবার জন্য আলাদা আলাদা লাইন।
মানুষগুলো যেমন ঘামতে ঘামতে টিকিটের জন্য দাঁড়ান। তেমনি যারা টিকিট দেয় তাদের মাথার উপরও একগাদা চাপ।লিখতে লিখতে কলমের কালি ফুরায়।কয়েকজন গার্ড আছেন। ওদের কাজ হল রোগীদের সাহায্য করা,লাইন ঠিক রাখা।
টিকিটের নম্বর দেখে দেখে রোগীদের রুম চেনানো। অবশ্য এখন সবাই বোধহয় জেনেই গেছে উখিয়া হাসপাতালের কোন রুমে কী সেবা দেয়া হয়।
উখিয়া হাসপাতালে একটা রুম আছে, তিন নাম্বার রুম। যেখানে রয়েছে মেডিকেলের ভাষায় এন সিডি কর্নার। মানে হল নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কর্নার। এখন ঘরে ঘরে অনেকেরই ডায়বেটিস প্রেসার। প্রতিদিন ঔষধ খেতে হয়। একেকটা ঔষধের কী যে দাম। আরো আছে রুটিন পরীক্ষা ।ডাক্তারের ফি। এই অতিরিক্ত দ্রব্য মূল্যের বাজারে একটা পরিবারের জন্য ভীষন চাপ হয়ে যায়। এই কর্নারটা সে সব ভেবেই করা হয়েছে। এখানে প্রত্যেক রোগীর জন্য একটা বই করে দেয়া হয়। যেখানে সব তথ্য গুছানো থাকে। কী ঔষধ খাবে, পরীক্ষার রিপোর্ট, খাবারের নিয়ম,পরবর্তী ভিজিটের তারিখ সব লেখা থাকে। ডায়বেটিস প্রেসার এর ঔষধ এক মাসের জন্য দিয়ে দেয়া হয়। দুইজন ডাক্তার বসেন সাথে রেজিস্টার খাতায় সব লিখে রাখেন একজন নার্স। প্রতিদিন গড়ে শুধু এই রুমেই একশো’র বেশী রোগী চিকিৎসা সেবা নেন।
রুম নাম্বার সাতে রয়েছে এ এন সি কর্নার। গর্ভবতী মায়েদের জন্য আলাদা একটা রুম। প্রথম ভিজিটেই এখানে একটা কার্ড দেয়া হয়। যেখানে নাম ঠিকানা কয়টা বাচ্চা আছে থেকে শুরু করে টিটি টিকার হিসাব ,ওজন, প্রেসার সাথে পরীক্ষার ফলাফলও লিখে রাখা হয়।সেই সাথে পরের বার কখন আসবে সেই তারিখটাও লেখা থাকে। গর্ভকালীন সময়ে কিছু জরুরী পরীক্ষা সব মায়েদেরই করতে হয়। স্বল্প মুল্যে উখিয়া হাসপাতালে করা হয়। এরমধ্যে এইচ আই ভি আর ভিডিআরএল এই দুটো পরীক্ষা একদম বিনামুল্যে করা হয়। গর্ভকালীন সময়ে খাওয়ার জন্য আয়রন আর ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেট এক মাসের জন্য দেয়া হয়।সপ্তাহে দুইদিন রবিবার এবং বুধবার কিশোরী এবং গর্ভবতী মায়েদের
টিটেনাস এর টীকা দেয়া হয়।
রুম নম্বর আট। উখিয়া হাসপাতালের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুম। ছোটছোট গুদুম গাদুম বাচ্চাগুলো কেন যেন সবচেয়ে বেশী অসুস্হ হয়। একটুতেই সর্দি জ্বর কাশি।যতনা বাচ্চার অসুখ তারচেয়ে বেশী হল মা বাবার অস্হিরতা । সেটা খুবই স্বাভাবিক।এই রুমটাতে কান্নাকাটির হল্লা তাই লেগেই থাকে।রকখনো বাচ্চা কখনো মা।চিকিৎসার একটা বড় অংশই তাই এখানে কাউন্সেলিং এ থাকেন। দুজন ডাক্তার নার্স সবাই হিমশিম। মাঝেমাঝে আবার দেখা যায় ডাক্তারের সাথে ক্ষুদে রোগীর সেলফি তোলার পর্ব চলছে। একদিন দেখি ওজন মেশিনটাতে শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছ ফুটফুটে একটা বাচ্চা। আর তাই দেখে সবার মুখে হাসি যেন আর ধরে না।
উখিয়া হাসপাতালে বর্তমানে মেডিসিন, পেডিয়াট্রিকস,গাইনী এই তিন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। প্রতিটা রুম থেকেই প্রয়োজন অনুসারে উনাদের কাছে রোগী পাঠানো হয়।
এছাড়াও অন্য রুম গুলো তে অন্যান্য রোগীর সেবা দেয়া হয়। সাপ্লাই অনুযায়ী ঔষধ দেয়া হয়। প্রয়োজনে একটা দুটো পরীক্ষা করা হয়।
আসলে মানুষের সাধ আর সাধ্যের ভারসাম্য কখনো হয়না। উখিয়া হাসপাতালে সেবা নিয়ে খুশী হন এমন সংখ্যাটাই অনেক বেশী। হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তাররা সেই বেশী সংখ্যার মানুষ গুলোর কথাই ভাবি।
সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখিয়ে কিছু ঔষধ নিয়ে ভাল হয়ে যারা আবার আসেন, বারবার আসেন, তারা মাঝেমাঝে যাবার সময়ে প্রানভরে দোয়া করে যান।
সত্যি বলছি এই এতটুকুতেই আমাদের সারাদিনের সব ক্লান্তি চলে যায়। স্বার্থক হয় বহির্বিভাগের সব আয়োজন।
লেখক: ডা: সাবরিনা নূর
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
মেডিকেল অফিসার
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।