টরন্টোর আকাশে বিরাজ করছে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা। ইভা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিচের ব্যস্ত পথচারীদের চলাচল দেখছিল। মনে পড়ছে ঢাকার সেই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট, যেখানে সৌরভের হাত ধরে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল সে। ১২ মে ২০২৪, তারা গোপনে বিয়ে করেছিল, কিন্তু সংসার করা হয়নি। তাকে জোর করে কানাডায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সে সৌরভকে মনে প্রাণে ভালবাসে। তাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারছে না। একটা শূণ্যতা অনুভব করছে সে। কানাডায় নিজেকে বন্দী ভাবতে শুরু করে।
আব্রাহাম বাংলাদেশি বংশদ্ভুত একজন কানাডার নাগরিক। তিনি টরন্টোতে বসবাস করেন এবং একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটি বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ইভার সাথে তার পরিচয় হয় ২০১৯ সালে, যখন তিনি বাংলাদেশে একটি পারিবারিক সফরে যান। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে ২০২১ সালে বিবাহবন্ধনে রূপ নেয়। তবে পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক মতবিরোধের কারণে তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। ইভা কখনোই আব্রাহামের সাথে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারেনি, তাই কানাডায় ফিরে এলেও সে সৌরভের কথা ভুলতে পারে না।
ইভা জানত, সে পালাতে চেয়েছিল সবকিছু থেকে, কিন্তু হৃদয় থেকে সৌরভের স্মৃতি মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না। ফোন হাতে নিয়ে সে বারবার সৌরভকে মেসেজ করতে চাইল, কিন্তু করল না। সে জানত, তাদের ভালোবাসার পরিণতি কতটা নিষ্ঠুর হতে চলেছে।
সেই মুহূর্তে, ঢাকার এক গলির মোড়ে সৌরভ ব্যস্ত ছিল ট্রেনের টিকিট কাটতে। ১ জুন, সে ময়মনসিংহ যাচ্ছে, ইভাকে খুঁজতে। কিন্তু সে জানত না, এই সফর তার জীবনের শেষ যাত্রা হতে চলেছে।
ওমর ফারুক সৌরভ ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজভাগ ইউনিয়নের তারাটি গ্রামের সন্তান। বাবা ইউসুফ আলী একজন সরকারি চাকরিজীবী, মা মাহমুদা আক্তার একজন গৃহিণী। তাদের সংসার ছিল শান্তিপূর্ণ, সুনিপুণ। একমাত্র বোন ফারজানা আক্তারের সাথে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। সৌরভ মেধাবী ছাত্র ছিল, গুলশানের প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছিল। শহুরে পরিবেশে বড় হলেও তার হৃদয়ে গ্রামবাংলার মাটি ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ছিল অটুট।
অন্যদিকে, ইভা এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে। তার বাবা ইলিয়াস উদ্দিন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা, যার ব্যক্তিত্ব ছিল দৃঢ় এবং কঠোর। ইভা ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনচেতা, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখত। তার পরিবার ময়মনসিংহে বসবাস করে এবং সমাজে তাদের বেশ নামডাক আছে।
এদিকে, ইভাকে খুঁজতে ১ জুন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ আসে সৌরভ। সে হয়তো চেয়েছিল ইভার পরিবারকে বোঝাতে, হয়তো চেয়েছিল শেষবারের মতো তাকে দেখতে। কিন্তু ইলিয়াস উদ্দিনের মনে তখন জমে ছিল প্রতিশোধের আগুন। তার ছেলে মৃদুল যখন জানালো যে সৌরভ ময়মনসিংহ এসেছে, তখনই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়।
সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ শহরের গোয়াইলকান্দি এলাকাযর বাসায় সৌরভকে ডেকে আনে চাচা ইলিয়াস। তখনো সে জানত না যে এটি তার জীবনের শেষ রাত। ময়মনসিংহ শহরের বাতাসে তখনো ভাসছিলো নিস্তব্ধতার আবরণ, কিন্তু ইলিয়াস উদ্দিনের বাড়ির ভেতরে তখন চলছিলো এক ভয়াবহ পরিকল্পনা। সৌরভ অন্ধকার কক্ষের কোণে বসে ছিল, হাত-পা বাঁধা, মুখে চাপা ভয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও সে বিশ্বাস করেছিল, ভালোবাসার মানুষ ইভার জন্য সে সবকিছু সহ্য করতে পারবে, কিন্তু আজ তার ভয় হচ্ছে, ভীষণ ভয়। একপর্যায়ে, ইলিয়াস ও তার শ্যালক আহাদুজ্জামান ফারুক মিলে তাকে আক্রমণ করে। ভারী কোনো অস্ত্র দিয়ে তার মাথায় আঘাত করতে থাকে। একসময় তার দেহ নিথর হয়ে পড়ে। এরপর তারা তার দেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে লাগেজে ভরে নিয়ে একটি প্রাইভেট কারে উঠায়। উদ্দেশ্য ছিল যমুনা নদীতে ফেলে দেয়া হবে মরদেহ। কিন্তু ফেলে দেয়া হয় মনতলা ব্রিজের নিচে।
সৌরভের বন্ধুরা যখন তার ফোন বন্ধ পায়, তখন তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে, কিন্তু তখনো কেউ জানত না, সৌরভ আর ফিরে আসবে না। ২ জুন সকালে, পুলিশের একটি দল মনতলা ব্রিজের নিচে ছিন্নভিন্ন একটি মরদেহ উদ্ধার করে। সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মিডিয়ায় এটি এক আলোড়ন তোলে। পত্রিকায় হেডলাইন হয়- ‘গোপনে চাচাতো বোনকে বিয়ে করাই কাল হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের’।
তার বন্ধুরা ফেসবুকে পোস্ট করতে থাকে, ‘সৌরভের জন্য ন্যায়বিচার চাই!’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে, সাংবাদিকরা এই নৃশংস হত্যার পেছনের কারণ জানতে চায়।
এই ফুটেজের সূত্র ধরেই, সৌরভ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করে পুলিশ। বেরিয়ে আসে নিহতের চাচা ইলিয়াস উদ্দিন ও তার শ্যালক আহাদুজ্জামান ফারুকের সংশ্লিষ্টতা। গ্রেফতার করা হয় তাদের দুজনকে, সাথে গাড়ির চালককেও। উদ্ধার করা হয় মরদেহ গুমে ব্যবহৃত প্রাইভেট কারও।
গ্রেফতারের খবর পেয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহতের স্বজনরা। নিহত সৌরভের বোন ফারজানা আক্তার বলেন, নৃশংসভাবে আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা ওদের ফাঁসি চাই। যারা হত্যার জড়িত, সবাইকে গ্রেফতার করার দাবি জানান তিনি।
সৌরভের বাবা ইউসুফ আলী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি চিৎকার করে বলেন, ‘যে ভাইকে বাবার স্নেহ দিয়ে বড় করেছি, সে-ই আমার সন্তানকে হত্যা করল! আমার সন্তানকে না মেরে আমাকে মারত!’ তার মা মাহমুদা আক্তার নির্বাক হয়ে যান, একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে তিনি যেন পাথর হয়ে যান।
এদিকে পুলিশের তদন্তে ইভা সম্পর্কে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, তিন বছর আগে কানাডা প্রবাসী এক ছেলেকে বিয়ে করে ইভা। এরপরও সৌরভের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে সে। ১২ মে গোপনে বিয়েও করে তারা। তবে পরিবার না মানায় প্রথম স্বামী আব্রাহামের কাছে কানাডায় চলে যায় ইভা।
ইভা কানাডায় থাকলেও এই সংবাদ শুনে সে নিশ্চুপ। তার ভালোবাসার মানুষটি নির্মমভাবে খুন হয়েছে, অথচ সে কিছুই করতে পারেনি। ইভা কি সত্যিই ভালোবাসত সৌরভকে, নাকি এটা শুধুই এক আবেগের খেলা ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কাছেও নেই।
••• লেখাটি ‘উত্তর আমেরিকার চালচিত্র‘গ্রন্থ থেকে সংকলিত।