শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৭:২৭ পূর্বাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

আফরোজা বেগমের হৃদয়বিদারক গল্প – DesheBideshe

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫




নিহত আফরোজা বেগম এবং আশরাফুল আলম সুমন

কানাডার সাস্কাচোয়ান প্রদেশের পূর্বতন রাজধানী ব্যাটলফোর্ড (Battleford) শহর। ব্যস্ত নগরজীবনের কোলাহল থেকে দূরে, এটি এক প্রশান্তির নগরী। এখানকার মানুষের জীবন শান্ত। নগরীর সবকিছুতে যেনো এক ধরনের শৃঙ্খলা বিরাজ করে। এ শহরেরই এক বাসিন্দা ছিলেন আফরোজা বেগম। যিনি নিজের জীবন এবং দুই সন্তান- ছেলে অন্তু এবং মেয়ে অন্বেষার ভবিষ্যৎ সুন্দর করে গড়তে একদিন পাড়ি জমিয়েছিলেন কানাডায়।

প্রাক্তন স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে তিনি বিয়ে করেন আশরাফুল আলম সুমনকে, যিনি ব্যাটলফোর্ড শহরের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা (CAO) হিসেবে কাজ করতেন। এটা আশরাফুলেরও দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। তাদের এক পুত্র সন্তান রয়েছে।

কানাডায় এতো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থেকেও আফরোজার মন পড়ে থাকত তার জন্মভূমি বাংলাদেশে। নীলফামারীর সেই নিভৃত গ্রামে যেখানে তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত। আধুনিক শহরের কোলাহল ছেড়ে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে সবসময় ছিল। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তার গ্রামের বাড়িতে এক খন্ড জমি কিনবেন, সেখানে একটি ছোট বাড়ি করবেন; যেখানে একদিন তার সন্তানরাও ফিরে যাবে, শেকড়ের সাথে সংযুক্ত হবে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশে ফিরে যাবেন এবং তার জমানো টাকা দিয়ে তিনি জমি কিনে বাড়ি করবেন। বিষয়টি শুনে আশরাফুল এ সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেন।

২০২৩ সালের শুরুতে আফরোজা বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন। সাথে তার কন্যা অন্বেষা ও স্বামী আশরাফুলও। সোজা তারা চলে গেলেন নীলফামারীর ডোমার উপজেলার নিজভোগদাবুড়ি গ্রামে। সেখানে গিয়ে প্রথমে তাদের বিয়ের এক কোটি টাকার কাবিননামা নিবন্ধন করে নেন (আগে কাবিন করা হয়নি)। এতে আশরাফুল তাঁর স্ত্রীর ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। ইতিমধ্যে জমি কেনার জন্য ব্যাংক থেকে ২৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেন আফরোজা। স্বামী আশরাফুল আলম এতে প্রবল আপত্তি জানান। এরপর থেকে তাদের মধ্যে একের পর এক ঝগড়াঝাটি শুরু হতে লাগলো।

ঢাকায় ফেরার পর একদিন হঠাৎ করেই আফরোজা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। কেউ জানে না, কোথায় গেছেন তিনি! আফরোজার পরিবারের সদস্যরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে দক্ষিণখানে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে খোঁজ নেন। কিন্তু শ্বশুরপক্ষ কোনো খোঁজ দিতে পারে না। তাদের কথা বার্তায়, চোখের ভাষায় অন্যকিছু বলছিলো।

আফরোজার বাবা আতাউল্লাহ মন্ডল জানান, তিন ছেলে ও এক মেয়ে তাঁর। আফরোজা প্রায় ৫ বছর (২০১৮ সাল থেকে) ধরে কানাডায় থাকেন। প্রথম সংসার ভেঙে যাওয়ার পর বছরখানেক আগে তিনি আশরাফুলকে বিয়ে করেন। প্রথম সংসারে আফরোজার দুই সন্তান রয়েছে। মণ্ডল আরও জানান, সর্বশেষ শুক্রবার সকালে তাঁর মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। দাঁত দেখাতে শনিবার তার একটি হাসপাতালে যাওয়ার কথা। গ্রাম থেকে এসে ওই হাসপাতালে পৌঁছে মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, এমন কথা হয়। পরদিন কমপক্ষে ৩০ বার ফোনে কল করলেও কেউ রিসিভ করছিল না। এরপর তিনি ভয় পেয়ে যান। চিন্তা করেন কোনো অঘটন ঘটেনিতো? বাবার মন। এদিনই তিনি ঢাকায় পৌঁছে সোজা মেয়ের শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণখানে যান। বিয়ের পর কখনও জামাইয়ের বাসায় যাওয়া হয়নি। শনিবারই প্রথম ওই বাসায় পা রাখেন। তিনি বলেন, ‘১৩ হাজার টাকার মিষ্টিসহ নানা জিনিস নিয়ে যাই। মেয়ের সন্ধান জানতে চাইলে ওই বাসার লোকজন কোনো সদুত্তর দেয় না।’ এর মধ্যে তাদের কেউ একজনের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, জামাই মেয়েকে ঢাকায় ফেলে রেখে কানাডায় চলে গেছে। পরে জামাইকে ফোন করলে সে বলে, কয়েকদিন পর আফরোজাকে আনা হবে। অসংলগ্ন সব কথাবার্তা বলছিল সে। একবার বলে, বনানীর এক বাসায় আফরোজাকে রাখা হয়েছে….। এরপর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়।

রাজিয়া বলেন, ‘পরদিন আশরাফুলের খালা পান্না চৌধুরী ফোন করে আমাকে একা যেতে বলেন এবং আশরাফুল আমার সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান। আমার টিম দূরে রেখে আমি একা তাদের বাড়ি যাই। ওখানে গেলে আশরাফুল ফোন দিয়ে বলেন, ‘আপনি ভিডিও কলে আসেন, মরদেহ কোথায় আছে দেখিয়ে দিচ্ছি’। আমি ভিডিও কল অন করি এবং রেকর্ড করতে থাকি। এ সময় আশরাফুল ভিডিও কলে আমাকে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেট থেকে বের হয়ে বাম দিকে যেতে বলেন। এরপর একটি জায়গা দেখিয়ে আশরাফুল বলেন, ‘এখানেই আফরোজাকে পুঁতে রেখেছি’। যেখানে পুতে রাখা হয়েছিল, সেই জায়গাতে বালি দেয়া হয়েছে একদিন আগে। বালি নরম থাকায় আমি কিছুটা খুঁড়তেই আফরোজার দেহের কিছু অংশ দেখতে পাই। তৎক্ষনাৎ আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করি। ইতিমধ্যে আমাদের টিমও ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়।

মামলার প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, নীলফামারি থেকে দক্ষিণখানের বাড়িতে ফেরার পর আফরোজাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আশরাফুল। হত্যাকান্ডের দিন (২৬ মে) বিকেলে আফরোজা, তার মেয়ে অন্বেষা ও আশরাফুলের ভাতিজি তানিশা একসঙ্গে বসুন্ধরার সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে আফরোজা না গিয়ে অন্বেষা ও তানিশাকে পাঠিয়ে দেন। ওইদিন রাত ১১টার দিকে সিনেমা শেষ হওয়ার পর বাসায় ফেরার সময় আশরাফুল তাদের ফোন দিয়ে এক ঘণ্টা পর আসতে বলেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। আর বৃষ্টির সময়টাকেই হত্যার উপযুক্ত সময় হিসাবে বেছে নেন আশরাফুল। তিনি নিজ হাতে বটি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন তার স্ত্রীকে। বাঁচার জন্য আফরোজা হয়তো চেষ্টা করেছিলেন, চিৎকার করেছিলেন; কিন্তু বৃষ্টির শব্দে আফরোজার সে চিৎকার হারিয়ে যায়। অবশেষে মৃত্যু নিশ্চিত হলে তার পরনের শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে তাঁকে বাসার পেছনে মাটি চাপা দেওয়া হয়। জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের তিন-চার দিন আগে বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে এ গর্তটি করা হয়েছিলো। এতেই বোঝা যায় পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে আফরোজাকে। অন্যরা সরাসরি খুনে জড়িত না থাকলেও মরদেহ গুমে সহায়তা করেন। আফরোজার মরদেহ উদ্ধারকালে তার মাথার পেছনে একটি, ঠোঁটে একটি, গলার বাম পাশে দুটি ও পিঠে একটি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।

পুলিশ নিশ্চিত করে যে আশরাফুল পরিকল্পিতভাবে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন এবং হত্যার পরপরই দুদিনের মাথায় (২৮ মে, ২০২৩) তিনি দেশ ত্যাগ করেন। যাবার সময় আফরোজার কাছে থাকা ২৮ লাখ বাংলাদেশি টাকা, কয়েক হাজার কানাডিয় ও ইউএস ডলার এবং তার মোবাইল ফোন নিয়ে গেছেন তিনি।

পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আশরাফুলের পিতা সামসুদ্দিন, ভাই সজিব, ভাইয়ের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার ও খালা পান্না চৌধুরীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এদিন (২ জুন) আফরোজার ছোট ভাই আরিফুল ইসলাম মামলা দায়ের করলে ঐ মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়।

এদিকে আফরোজার মেয়ে অন্বেষা (১৭) কিছু না বুঝেই আশরাফুলের কথা মতো তার সাথে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। পরে খুনের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে আফরোজার বাবা আতাউল্যাহ মণ্ডল নাতি আবরার হোসেন অন্তুকে (২২) ফোন করে মর্মান্তিক এ ঘটনার কথা জানান। ঘটনা অবহিত হওয়ার পর অন্তু ব্যাটলফোর্ড পুলিশের সহায়তা নিয়ে তার বোন অন্বেষাকে নিজ হেফাজতে নিয়ে নেয়। এখন তারা দুই ভাই-বোন একসঙ্গে আছে।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অনেকে। প্রথমতঃ, বাংলাদেশের পুলিশ আশরাফুলকে গ্রেপ্তার করতে পারবে কি না! দ্বিতীয়তঃ, কানাডার পুলিশ আশরাফুলকে গ্রেপ্তার করতে গেলে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ লাগবে; সেগুলো পাওয়া যাবে কি না! এছাড়া যেহেতু কানাডার সাথে বাংলাদেশের কোনো আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি (ট্রিটি) নেই; সেজন্যে কানাডা সরকার তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে কি না তা একেবারেই অনিশ্চিত!

••• লেখাটি ‘উত্তর আমেরিকার চালচিত্র‘(২য় খণ্ড) গ্রন্থ থেকে সংকলিত।



আরো খবর: