[ad_1]
ঢাকা, ১২ অক্টোবর – ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে গিয়ে হত্যা ও গণহত্যায় অংশ নেওয়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের বিচারের আওতায় আনতে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আন্দোলন দমনের নামে পুলিশের কার কী ভূমিকা ছিল, তা খতিয়ে দেখবে তদন্ত সংস্থা। এরপর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর অংশ হিসেবে ঢাকায় ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে ১৮ ও ১৯ জুলাই এবং ৩ থেকে ৫ আগস্ট পাঁচ দিনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কার কার নির্দেশে গুলি করা হয়েছিল, কে কত গুলি করেছিল, মাঠ পুলিশের কোন কোন সদস্য আন্দোলন দমনে অংশ নিয়েছিল তার বিস্তারিত তথ্য জানতে ডিএমপিকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। সে অনুযায়ী ডিএমপি কাজ শুরু করেছে।
অন্যদিকে, আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। এ কারণে দলীয়প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী, এমপিদের পাশাপাশি এসব ক্যাডারেরও বিচারের আওতায় আনতে তদন্ত শুরু করেছে তদন্ত সংস্থা। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, বিচার শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে ১৮ ও ১৯ জুলাই এবং ৩ থেকে ৫ আগস্ট ৫ দিনে এই পাঁচ দিন রাজধানীতে
মোতায়েনকৃত পুলিশ ফোর্সের সিসির (কমান্ড সার্টিফিকেট) তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারকে। এ ছাড়া ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ডিএমপির সব থানার ওসিসহ কর্মকর্তা এবং ডিবির এসআই-পরিদর্শকদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে জমা দিতে বলা হয়েছে অস্ত্রের ব্যালিস্টিকস পরীক্ষার রিপোর্ট। ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনালের চাহিদা অনুযায়ী, তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে ডিএমপিও। ঢাকায় ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে। এতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ হতাহত হয়।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার গতকাল শুক্রবার রাতে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে আমরা চিঠি পেয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের পুলিশের সিসিসহ সব কিছু নথিভুক্ত আছে। আমরা তথ্য পাঠাব।
পুলিশসহ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের বিচারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের আলাদা বিচার হবে না। আমরা দেখছি অপরাধ। একটা অপরাধ গ্রাউন্ডে যিনি করলেন এবং পেছন থেকে যারা কমান্ড করেছেন সেটা দেখা হবে। কোথায় থেকে অপরাধের সিদ্ধান্ত হলো এবং কার হুকুমে হলোÑ পুরো বিষয়টি তদন্ত করে সেটাকে আমরা বিচারের আওতায় নিয়ে আসব।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন একটা বিশেষ আইন উল্লেখ করে প্রধান প্রসিকিউটর বলেন, মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ হলে তার বিচার কেবল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হবে। এটা বাহিনীর নিজস্ব আইনে বিচারযোগ্য না। যত বাহিনী আছে, তাদের যে কেউ যদি অপরাধ করে, তাহলে এই আইনের আওতায় আসবে। অপরাধের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় যত প্রশাসনযন্ত্র, মন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে কমান্ড স্ট্রাকচার সবাইকে বিচারের আওতায় আসতে হবে।
জুলাই ও আগস্ট মাসে ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করা এসআই ও ইন্সপেক্টর পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চরমে পৌঁছলে পুলিশের দায়িত্ব নির্দিষ্ট জায়গায় ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে সিসি লিখে তারপর থানা থেকে বের হওয়ার সময় ছিল না। বিশেষ করে ১৭ ও ১৮ জুলাই এবং ৩ থেকে ৫ আগস্ট থানা পুলিশ সিসি লিখে বের হয়নি। তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠে ছিলেন, তারা যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে মাঠে দায়িত্ব পালন করেছেন। কে কত গুলি চালিয়েছে সেই হিসাব সঠিকভাবে বের করা কঠিন। অনেক সময় দেখা গেছে, অধস্তন পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গুলি চালিয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একজন পুলিশ সদস্য বলেন, সকালে শহীদ মিনারে ছাত্ররা জমায়েত হলে তাদের সরানো যাচ্ছিল না। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। এসেই এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। সিসিতে শহীদ মিনারে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের নাম পাওয়া যাবে। কিন্তু গুলি তো ছুড়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে শুধু সিসি দেখে অপরাধী শনাক্ত করতে চাইলে জটিলতা তৈরি হবে।
তবে সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, পুলিশ কীভাবে কাজ করবে তার নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। ঊর্ধ্বতনদের অবৈধ আদেশ শুনতে পুলিশ বাধ্য নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যদের পাশাপাশি পুলিশ ও প্রশাসনের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদেরও আসামি করা হয়েছে। সারাদেশে ৩০০টি মামলায় অন্তত ৪৫০ জন পুলিশকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় রয়েছেন চারজন সাবেক আইজিপি ও ২০ জন অতিরিক্ত আইজিপি। দুই আইজিপিসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন পুলিশের ১৭ জন কর্মকর্তা। পৃথক মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণীত হয়। এ আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের নেতাদের বিচার করা হয়েছে। আইনের ৩ (১) ধারায় বলা আছে, আইনের ২ নম্বর উপধারায় উল্লিখিত যে কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সংস্থা বা কোনো সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর কোনো সদস্যের জাতীয়তা যাই হোক না কেন, তা যদি এই আইন প্রবর্তনের আগে বা পরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার এবং শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার প্রচুর আলামত পাওয়া গেছে। আমরা জুলাই-আগস্ট মাসের পৈশাচিক গণহত্যার বিচার অচিরেই শুরু করব, তখন দেখবেন, আমাদের অনেক দ্বিধা, অনেক প্রশ্ন দূর হয়ে যাবে।
সূত্র: আমাদের সময়
আইএ/ ১২ অক্টোবর ২০২৪
[ad_2]