নয়াদিল্লি, ০৫ সেপ্টেম্বর – সনাতন ধর্মকে নির্মূল করার কথা বলে পুরো ভারত জুড়ে এক ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্তালিনের পুত্র উদয়নিধি স্তালিন। তিনি ওই রাজ্যের একজন মন্ত্রীও।
চেন্নাইতে লেখক-শিল্পীদের এক সভায় মি. স্তালিন বলেন, মশা, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া বা করোনা ভাইরাসের মতো জিনিসের বিরোধিতা করা যায় না, এগুলিকে নির্মূল করতে হয়। সনাতন ধর্মও এরকম। এর বিরোধিতা না করে এটিকে নির্মূল করা উচিত।“তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ শুধু যে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি করছে, তা নয়। কংগ্রেসের একাধিক নেতা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সহ বিরোধী দলগুলিও ‘সনাতন ধর্ম’ নিয়ে করা উদয়নিধি স্তালিনের বক্তব্য খণ্ডন করেছে।
বিজেপি নেতা ও দলের তথ্যপ্রযুক্তি সেলের প্রধান অমিত মালবীয় বলছেন যে সনাতন ধর্মকে ‘নির্মূল’ করার কথা বলে ভারতে বসবাসকারী ৮০ শতাংশ মানুষ যে সনাতন ধর্ম মেনে চলেন, তাদের আসলে ‘গণহত্যা’ করার কথা বলেছেন ওই তামিল নেতা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপির শীর্ষস্থানীয় সব নেতা নেত্রীই বিষয়টি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন।
তারা মনে করছেন যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ‘নির্মূল’ করার কথা বলা হয়েছে। তবে সনাতন ধর্ম আর হিন্দু ধর্ম এক না পৃথক, সনাতন ধর্ম কী, তা নিয়ে ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও মত পার্থক্য আছে।
সনাতন ধর্ম নিয়ে কী বলেছেন স্তালিন?
চেন্নাইতে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন তামিলনাড়ু প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সমিতির একটি সভায় উদয়নিধি স্তালিন বক্তব্য রাখতে গিয়েছিলেন সম্প্রতি। ওই সভার নামই ছিল ‘সনাতন বিলুপ্তি সম্মেলন’।
সেখানে স্তালিন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএসের অবদান শীর্ষক ব্যঙ্গচিত্র সংকলন প্রকাশ করেন। এরপরে তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, “এই সম্মেলনের শিরোনামটি খুব ভাল। ‘সনাতন বিরোধী সম্মেলনের’ পরিবর্তে, আপনারা ‘সনাতন বিলুপ্তি সম্মেলন’ আয়োজন করেছেন। এর জন্য আমার অভিনন্দন। আমাদের কিছু জিনিস শেষ করতে হবে। আমরা এগুলোর বিরোধিতা করতে পারি না। মশা, ডেঙ্গু জ্বর, ম্যালেরিয়া, করোনা ভাইরাস ইত্যাদির বিরোধিতা করা উচিত নয়, আমাদের উচিৎ এগুলো নির্মূল করা। সনাতন ধর্মও এরকম। তাই এর বিরোধিতা না করে এটাকে নির্মূল করা উচিত। সনাতন সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি সেলের প্রধান অমিত মালবীয় ওই ভাষণের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যম এক্স (আগেকার টুইটার) –এ প্রকাশ করে লেখেন, উদয়নিধি স্তালিন, তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্তালিনের পুত্র এবং ডিএমকে সরকারের একজন মন্ত্রী, সনাতন ধর্মকে ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গির সঙ্গে তুলনা করছেন।
“তার মতে (মি. স্তালিনের) এগুলোর শুধু বিরোধিতা নয়, নির্মূল করতে হবে। স্বল্প কথায়, ভারতের ৮০% মানুষ যে সনাতন ধর্ম অনুসরণ করে, তাদের গণহত্যা করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি,” এক্স-এ লিখেছেন মালবীয়।
ওই পোস্টে তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন যে বিরোধী দলগুলির জোটের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ডিএমকে এবং কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের জোট-সঙ্গী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, বিজেপির শীর্ষস্থানীয় সব নেতারাই মি. স্তালিনের বক্তব্যের প্রবল বিরোধিতায় নেমেছেন।
অমিত শাহ রাজস্থানে এক নির্বাচনী জনসভায় বলেছেন, এক মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র সনাতন ধর্ম নির্মূল করার কথা বলছেন। এরা ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি এবং তুষ্টিকরণের জন্য সনাতন ধর্মকে নির্মূল করতে চাইছেন। আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সনাতন ধর্মের অপমান এটা।
মি. স্তালিনের বক্তব্যের সূত্রে কংগ্রেস এবং বিরোধী-দলীয় জোট ‘ইন্ডিয়া’কেও আক্রমণের নিশানা করছেন বিজেপি নেতা-নেত্রীরা।
অন্যদিকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মি. স্তালিনের ভাষণ নিয়ে এখনও কোনও মন্তব্য না করলেও দলের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক কেসি ভেনুগোপাল বলেছেন, আমরা সর্বধর্ম সমভাবে বিশ্বাস করে। এটা কংগ্রেসের চিন্তাধারা, কিন্তু এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই স্বাধীন চিন্তাধারার স্বাধীনতা আছে।
‘ইন্ডিয়া’ জোটের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শরিক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী কারও নাম না নিয়ে বলেছেন কারও ধর্মীয় ভাবনায় আঘাত লাগে, এমন কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়।
তার কথায়, আমি সনাতন ধর্মকে সম্মান করি। তামিলনাডুর মানুষদের প্রতিও আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু আমার অনুরোধ ধর্মের ভাবাবেগটা অন্য ব্যাপার। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ। আমি সনাতন ধর্মকে শ্রদ্ধা করি। চার্চ, মন্দির, মসজিদে যাই। আমাদের এমন কিছুতে সামিল হওয়া উচিত নয়, যার ফলে কারও ভাবাবেগে আঘাত লাগে।
বিজেপির আক্রমণের মুখে পড়ে মি. স্তালিন বলছেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের গণহত্যার কথা আমি কখনই বলি নি। সনাতন ধর্ম আসলে একটা ভাবধারা, যা মানুষকে জাতি আর ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করে।
তিনি যা যা বলেছেন, সেই বক্তব্যেই অনড় থাকছেন, এমনটাও বলছেন তিনি। ওই বক্তব্যের জন্য যদি কোনও আইনি পদক্ষেপের মুখে পড়তে হয়, তা মোকাবিলা করতেও প্রস্তুত এমনটাও জানিয়েছেন উদয়নিধি স্তালিন।
স্তালিনের বক্তব্য কি হিন্দু-বিরোধী?
বিজেপি উদয়নিধি স্তালিনের বক্তব্যকে হিন্দু-বিরোধী বলে কড়া প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, কিন্তু ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে মতপার্থক্য আছে যে সনাতন ধর্ম আর হিন্দু ধর্ম এক কী না, তা নিয়ে।
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও পশ্চিমবঙ্গ বৈদিক অ্যাকাডেমির সচিব নব কুমার ভট্টাচার্য বলছেন, হিন্দু ধর্মই সনাতন ধর্ম। তবে পরম্পরা হিসাবে এই সনাতন ধর্ম বৈদিক যুগেরও আগে থেকে চলে আসছে। তার কথায়, এটা একটা জীবনধারা, যা পরম্পরা হিসাবে আদি কাল থেকে চলে আসছে, পরে এর সঙ্গে ধর্ম মিলেমিশে গেছে। এর মধ্যে যে শুধু ধর্ম আছে তা নয়। ধর্মের সঙ্গে পরম্পরাগত ভাবে আমাদের জীবনে যে আচার ব্যবহার চলে আসছে, সেই সব কিছু মিলিয়েই সনাতন ধর্ম। সনাতনীরাই হিন্দু, তবে হিন্দু নামটা অনেক পরে এসেছে, সেটা বিদেশিদের দেওয়া নাম। কাশীর পণ্ডিত সমাজ ১৮৭০ সালে একটা সভা করেন যেখানে তারা প্রশ্ন তোলেন যে তারা তো সনাতনী, তাদের কেন হিন্দু বলা হবে।
পুরাণ বিশেষজ্ঞ শরদিন্দু উদ্দীপনও বলছিলেন, সনাতনী পরম্পরা আর্যরা ভারতে আসার আগে থেকেই ছিল। সনাতন ধর্ম যে একটা পরম্পরা, সেটা মি. ভট্টাচার্যের মতোই বলছিলেন মি. উদ্দীপনও। তবে তার ব্যাখ্যা একটু ভিন্ন।
“আর্যরা আদতে ইউরেশীয় গোষ্ঠীর এবং তারা যে ভারতে এসেছিল, সেখানে আগে থেকেই একটা সভ্যতা ছিল। আর্যরা আসার আগে যে সভ্যতা বিরাজমান ছিল ভারতে, সেটাই সনাতন পরম্পরা। এই পরম্পরার কথা প্রথম লিপিবদ্ধ হয় ধম্মপদে। সনাতন শব্দটা প্রথম প্রকাশিত হয় মহামতি গৌতম বুদ্ধের মুখ থেকে।
তিনি বলেছিলেন, নহি বেরেন বেরানি সমন্তীধ কুদাচনং। অবেরেণ চ সম্ম্নিত এস ধম্মো সনন্তনো।
এর অর্থ হল, শত্রুতা দিয়ে শত্রুতা শেষ করা যায় না, ব্যাখ্যা করছিলেন শরদিন্দু উদ্দীপন।
তিনি আরও বলছিলেন যে গৌতম বুদ্ধ ‘সনাতন’ শব্দটার প্রথম উল্লেখ করেছিলেন, তার অর্থ এই নয় যে ভাবধারা হিসাবে ‘সনাতন’ তখনই সৃষ্ট হল।
“বহু প্রাচীন কাল থেকে, গৌতম বুদ্ধের পূর্বজদের সময় থেকে যে জীবন শৈলী চলে আসছে, সেটার কথাই তিনি উল্লেখ করেছিলেন,” জানাচ্ছিলেন মি. উদ্দীপন।
দক্ষিণ ভারত, বিশেষত তামিলনাডুতে, হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে দ্রাবিড়ীয় ভাবধারা খুবই জনপ্রিয় এবং ১৯৬৭ সালের পর থেকে ওই রাজ্যে দ্রাবিড় রাজনৈতিক দলগুলিই ক্ষমতায় থেকেছে।
গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে সামাজিক নেতা পেরিয়ারের হাত ধরে তামিলনাডুতে দ্রাবিড় ভাবধারার সূচনা হয়। তারই সূত্র ধরে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে আরেক জনপ্রিয় দ্রাবিড় নেতা আন্নাদুরাই প্রতিষ্ঠা করেন ডিএমকে দলটির।
উদয়নিধি স্তালিন, তার বাবা এবং দাদু, তিনজনই দ্রাবিড় নেতা। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্তালিনের বাবা, চিত্রনাট্যকার এম করুণানিধিও দ্রাবিড় মুনেত্রা কাঝাগম বা ডিএমকের প্রধান এবং একাধিকবার তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন।
দ্রাবিড়ীয় রাজনীতির মূলে রয়েছে উত্তরভারতীয়, আরও বিশেষ করে বললে আর্য ভাবধারার সঙ্গে তাদের বিরোধ।
বিবিসি তামিল বিভাগের সম্পাদক থাঙ্গাভেল আপ্পাচি বলছিলেন, দ্রাবিড়ীয় রাজনীতির শুরুটাই হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা দিয়ে। পেরিয়ার যে দ্রাবিদার কাঝাগাম বা ডিকে গঠন করেছিলেন, তাদের মুল নীতি ছিল উত্তর-ভারত বিরোধী, ব্রাহ্মণ বিরোধী, হিন্দি বিরোধী এবং নিরীশ্বরবাদ। পরবর্তীকালে ডিকে ভেঙ্গে যে ডিএমকে তৈরি হয় তারাও অনেকটা একই পথ অনুসরণ করে চলে।
সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
আইএ/ ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩