নরসিংদীর মনোহরদীতে একটি বাড়ির খড়ের গাদার নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া মরদেহের পরিচয় মিলেছে। মিঠু হোসেন (২৪) সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রায়পুর এলাকার মৃত মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। তিনি সিরাজগঞ্জের একটি ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজের বিএ প্রথম বর্ষে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে শাড়ির ব্যবসা করতেন। বাবুরহাটের শাড়ি সম্পর্কে ধারণা নিতে প্রথমবারের মতো নরসিংদীতে এসেছিলেন। ফেসবুকে পরিচয় হওয়া দুই বন্ধুর ভরসায় নরসিংদীতে আসার পর অপহরণের শিকার হন তিনি।
পরিবার ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে হত্যার কারণও। মো. মিঠু হোসেনকে অপহরণের পর এক লাখ টাকা মুক্তিপণ না পেয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মরদেহ গুম করার জন্য খড়ের গাদার নিচে মরদেহ ফেলে রাখে অপহরণকারীরা।
পুলিশ জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে মনোহরদীর একদুয়ারিয়া ইউনিয়নের হুগলিয়াপাড়া গ্রামের মো. রূপচানের বাড়ির খড়ের গাদার নিচে ওই যুবকের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। ওই যুবককে আগে কখনো এই এলাকায় দেখা যায়নি বলে জানান স্থানীয় ব্যক্তিরা। পরে খবর পেয়ে দুপুর ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ ওই খড়ের গাদার নিচ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে। যুবকের পিঠে, গলায় ও চোখের নিচে রক্তাক্ত জখম ছিল। এ ছাড়া তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে রাতেই সিরাজগঞ্জ থেকে মিঠু হোসেনের পরিবারের সদস্যরা মনোহরদী থানায় আসেন। রাত ১২টার দিকে পুলিশের কাছে থাকা ছবি দেখে মরদেহ শনাক্ত করেন মিঠুর বড় বোন মিনু আক্তার। অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে ওই রাতেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন নিহত ব্যক্তির বড় বোন মিনু আক্তার।
মামলার বাদী ও মিঠুর বড় বোন মিনু আক্তার বলেন, বুধবার রাত ৮টার একটু আগে মিঠু তার নিজের মুঠোফোন নম্বর থেকে কল করে তাদের জানান, তাকে আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে। তার বিকাশ নম্বরে দ্রুত এক লাখ টাকা পাঠিয়ে দিতে বলেন মিঠু, নইলে ‘তারা আমাকে মেরে ফেলবে’ বলেন। তখন অপহরণকারীদের একজন ফোনটা ধরে বলেন, ‘আপনারা এই মুহূর্তে যদি এক লাখ টাকা পাঠান, তাহলে আপনার ভাইকে আমরা ছেড়ে দেব।’ মিনু আক্তার তাকে বলেন, ‘এখন তো রাত প্রায় ৮টা বাজে, এই সময় তো কারও কাছে টাকা চেয়ে পাব না, একটু সময় দিন, আমি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’ রাত ১২টা পর্যন্ত অন্তত ৫০ বার মিঠুর ফোনেই অপহরণকারীদের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। ফোনে কথা বলার পুরোটা সময় মারধর ও মিঠুর কান্নার শব্দ শুনেছেন।
মিনু আক্তার বলেন, ‘রাত ১২টার দিকে মিঠুর সঙ্গে যখন আমাদের শেষ কথা হয়; মিঠু বলছিল, আপু তোরা বোধ হয় আমাকে আর বাঁচাতে পারলি না। আমার শেষ ইচ্ছা, মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলিয়ে দে। মায়ের সঙ্গে মিঠু কথা বলার পর থেকেই সারা রাত তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। এরপরই সিরাজগঞ্জ সদর থানায় গিয়ে এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করি আমরা।’
মিনু আক্তার আরও বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে আবার মিঠুর নম্বর থেকে কল দিয়ে অপহরণকারীরা জানতে চান, টাকা পাঠাচ্ছি না কেন? আমি তাকে বলি, আমার ভাইকে ফোনটা দেন, তার সঙ্গে কথা বলে এখনই টাকা পাঠাচ্ছি। কিন্তু তিনি বলেন, আগে টাকা পাঠান তারপর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবেন। এরপর ফোন কেটে দিয়ে মুঠোফোন অফ করে দেন। এটাই ছিল তাদের সঙ্গে আমাদের শেষ কথা। পরে জানতে পেরেছি, ওই সময় মিঠুর লাশ উদ্ধার করছিল পুলিশ। অর্থাৎ মিঠুর মৃত্যুর পরও মুক্তিপণ চাইছিলেন তারা।’
নিহত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মিঠুর বাবা ছয় মাস আগে মারা গেছেন। তার মা–ও দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত। বাবার মৃত্যুর পর থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে শাড়ির ব্যবসা করে সংসার চালাতেন মিঠু। স্থানীয় বিভিন্ন হাট থেকে শাড়ি সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি করলেও নরসিংদীর বাবুরহাটের কাপড় বিক্রির ইচ্ছা ছিল তার। এই জন্য গত বুধবার সকালে সিরাজগঞ্জ থেকে নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন। ঢাকায় পৌঁছার পর তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতে দুপুরের খাবার খান। পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে নরসিংদী পৌঁছে পরিবারের সদস্যদের কাছে কল করে ঠিকঠাক পৌঁছানোর খবর জানান। তবে নরসিংদীতে ঠিক কাদের কাছে তিনি গিয়েছিলেন, তা কেউ জানতেন না।
মনোহরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনিচুর রহমান বলেন, মিঠু হোসেন নামের ওই যুবককে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে পুলিশ নানা দিক থেকে তদন্ত শুরু করেছে। এ ছাড়া ময়নাতদন্তের পর নিহত ব্যক্তির লাশ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।