ইয়াবার বিস্তার ঘটিয়ে আব্দুর রহমান বদি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক মাদক গডফাদারের খেতাব, আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য গত ১৭ বছরে নিজের নির্বাচনী এলাকাকে পরিণত করেছেন অপরাধের স্বর্গরাজ্যে।
বদি যদি রাজা হন তাহলে মাদক,চোরাচালান, অপহরণ,চাঁদাবাজি,হত্যার সহ নানা অপরাধে কুখ্যাত এই রাজ্যের সেনাপতি হিসেবে আসবে টেকনাফের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের নাম।
গত ২৯ মে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে বদি ম্যাজিকে দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া জাফর মাত্র দুই মাস পর সরকার পতন হলে ১৯ আগস্ট স্বপদ থেকে অপসারিত হন।
স্বৈরাচার পরবর্তী সময়ে সর্বশেষ ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত টেকনাফ উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জাফর’কে প্রধান অতিথির আসনে দেখা যায়।
যদিও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন টেকনাফে সহিংসতার নেতৃত্বে ছিলেন জাফর,
গত ১৮ আগস্ট টেকনাফ থানায় দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম আসামী তিনি।
উক্ত মামলায় বদি র্যাবের হাতে চট্টগ্রামে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে বন্দি, গা ঢাকা দিয়ে থাকা বদি উস্তাদ খ্যাত জাফর আলমের নেই কোনো হদিস।
সীমান্ত ‘মাফিয়া’ জাফরের উত্থান যেভাবে :-
মিয়ানমার সীমান্ত ঘেষা টেকনাফ সদর ইউপির লেঙ্গুরবিল গ্রামের বাসিন্দা সুলতান আহমেদের পুত্র জাফর প্রথম জীবনে ছিলেন শ্রমিকনেতা নামধারী দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ।
আরাকান সড়ক হয়ে টেকনাফ স্থল বন্দরমুখী সব বাণিজ্যিক ট্রাক’কে কেন্দ্র করে রমরমা চাঁদাবাজি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা জাফর অবৈধ টাকার ও সন্ত্রাসী চাদাবাজদের ক্ষমতার জোরে একসময় নির্বাচিত হন ইউপি সদস্য।
পরে কৌশলে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে টেকনাফ সদরের ইউপি চেয়ারম্যান হয়ে যান তিনি। কালের পরিক্রমায় নানা রুপে আবির্ভূত হয়ে শুধুই বেড়েছে বদি ওস্তাদ খ্যাত জাফরের অপরাধ এবং বনে গেছেন অঢেল সম্পদের মালিক।
আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের সময় গ্রেফতার হলে কারাগারে থাকাকালীন আবদুর রহমান বদি ও খাইরুল আলম চৌধুরী’র সাথে গড়ে ওঠে সখ্যতা, আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে শুরু হয় জাফরের নতুন অধ্যায়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি হয়ে দলটির সমর্থন ও বদির ছত্রছায়ায় চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে প্রথমবার উপজেলা চেয়ারম্যান হন জাফর। পরেরবার বিপুল ভোটে পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত হলেও পরে বদি বদনায়তায় জাফর কক্সবাজার জেলা পরিষদ সদস্য হয়ে ক্ষমতাসীন পদ ধরে রাখেন।
টেকনাফ স্থলবন্দরের বাণিজ্য ‘জিম্মি :-
প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কারণে টেকনাফ স্থলবন্দর জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাবান বদি এই বন্দরের একক নিয়ন্ত্রক, আমদানি-রপ্তানির সেবা দানকারী সিএন্ডএফ এজেন্সিগুলো চলতো তার কথা মত।
বিশ্বস্ত সহচর জাফর’কে উস্তাদ ডাকেন বদি, যার উস্তাদিতে জিম্মি ছিলো বন্দর কেন্দ্রিক বাণিজ্যে জড়িত ব্যবসায়ীরা।
বদির চারটি এজেন্সি – মেসার্স এ রহমান এজেন্সি (নিজের নামে), মেসার্স সামিয়া এন্টারপ্রাইজ (তার মেয়ের নামে), মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ (ছেলের নামে) এবং মেসার্স শাহীন অ্যান্ড সন্স (পুত্রবধূর নামে) সহ কমপক্ষে ৭ টি এজেন্সির মাধ্যমে জাফর পরিচালনা করতেন তার অবৈধ ব্যবসা।
বিপুল অর্থের শুল্কফাঁকি দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান আমদানি-রপ্তানি করতো বলে অভিযোগ আছে, এক্ষেত্রে জড়িত ছিলেন বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
একসময় টেকনাফ স্থলবন্দরে চুক্তিভিত্তিক দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করা ‘ বন্দর ইসলাম ‘ খ্যাত নুরুল ইসলামের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ৪৬০ কোটি টাকা।
আলোচিত এই দুর্নীতিবাজকে গ্রেফতারের পর র্যাব জানায়, ‘রাজনৈতিক’ পৃষ্ঠপোষকতায় অপর্কম চালিয়ে গেছেন তিনি।
টেকনাফের মেয়ে বিয়ে করায় জাফর ভোলার নুরুল ইসলাম কে ‘জামাই’ সম্বোধন করতেন, নিজে আয়ের পাশাপাশি কথিত শশুড়কেও তিনি কামিয়ে দিয়েছেন হাজার কোটি টাকা।
পারিবারিক ব্যবসা ‘ইয়াবা’:-
নিজের কন্যাদের বিবাহসূত্রে উখিয়া-টেকনাফের ২ প্রভাবশালী ও সাবেক এমপি পরিবারের ২ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ রয়েছে তার আত্মীয়তা। সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর বড় পুত্র টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মুর্শেদ ও সাবেক এমপি জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরীন ভাইপো বান্নারকে সুকৌশলে তিনি বানিয়ে নেন তার মেয়ের জামাই। ক্ষমতার পালাবদলে যেন তার অপরাধ জগতের সাম্রাজ্য অক্ষত থাকে সেই জন্য তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্নীয়তার সম্পর্ক তৈরি করেছেন বদি’র থিংক ট্যাংকার জাফর। অপরদিকে তিনি তার দিনও রাতে পুরোটা সময় কাটান ও অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করেন সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি’র সাথে।
অন্যদিকে ছেলে মোস্তাক আহমেদ, দিদার হোসেন, মো. শাহজাহান, সহ ভাই নজরুল ইসলাম, ভাতিজা রুবেল ও সোহেল এর মাধ্যমে জাফর সামলেছেন ইয়াবার রমরমা কারবার।
অবৈধ এই ব্যবসাকে পারিবারিক ব্যবসায় রুপান্তর ঘটানোর কারণে জাফর এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ঠাঁই হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা শীর্ষ ইয়াবা ও মানবপাচারকারীদের তালিকায়।
পিতার অপকর্মের সহযোগী বড় পুত্র মোস্তাক হঠাৎ অজ্ঞাত হয়ে যান ২০১৬ সালে, নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবার মোস্তাককে গুম করা হয়েছে দাবী করে।
তবে টেকনাফে প্রচার রয়েছে মোস্তাক জীবিত আছেন, বিদেশে অবস্থান করে তিনি পিতার সাম্রাজ্য তদারকি করছেন।
অবৈধ অস্ত্রধারী ছোট ছেলে শাহজাহান মিয়াকে ইয়াবার কালো টাকায় টেকনাফ সদরের চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন জাফর, ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত যার শাসনামলে নির্মমতা ও বর্বর নির্যাতনের নজির দেখেছে সেখানকার সাধারণ বাসিন্দারা।
চলছে দুর্নীতির মামলা :-
বহু মামলার আসামী জাফর, তবে একটি দুর্নীতির মামলায় জেলহাজতে যেতে হয়েছে তাকে।
৩ কোটি ৭৮ লাখ ৬০ হাজার ১০ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়াও জনপ্রতিনিধি থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৪ কোটি ৯০ লাখ ৬৯ হাজার ১২৪ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জনপূর্বক ভোগ দখলে রাখার অপরাধে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
দুদকের তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক (বর্তমান সহকারী পরিচালক) মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদি হয়ে ২০১৯ সালে ডবলমুরিং থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলার ভিত্তিতে জামিন চাইতে যাওয়া জাফর’কে ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি কারাগারে পাঠান আদালত।
এদিকে রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) জাফর পুত্র টেকনাফ সদরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়াকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে বলে সচেতন মহলের ধারনা।
সম্প্রতি আন্দোলনে ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাহজাহান প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে হামলায় জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে ভিডিও ফুটেজে। তাছাড়াও ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন বদি ও জাফরের নেতৃত্বে জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক ত্যাগী জননেতা মোঃ আবদুল্লাহ’র মার্কেট, অফিস ভাংচুর ও লুটপাট চালায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এই সময় বিএনপি’র ত্যাগী নেতা ও বিগত ১৬ বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীর ধারা বহুভাবে নির্যাতিত, বারবার হামলা শিকার এবং অসংখ্য মিথ্যা মামলায় আসামি হওয়া মোহাম্মদ আবদুল্লাহকে হত্যা করার জন্য হণ্য হয়ে খুজে ছিলো জাফর গং। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনসাধারণের প্রতিরোধের মুখে বিএনপি নেতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানে রক্ষা পান।
মাদক পাচারের যারা জড়িত:-
টানা ১৬ বছরের একক ক্ষমতাবলে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের ডন হয়ে উঠেন আবদুর রহমান বদি। তিনি নিজেই এমপি থাকা অবস্থায় সরকারের করা প্রথম মাদকদ্রব্য ইয়াবা কারবারিদের একটি তালিকা প্রকাশিত হয় বিগত ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওই সময়ের পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) প্রণব কুমার নিয়োগী স্বাক্ষারিত তালিকাটিতে সীমান্তে ভয়াবহ মাদক ইয়াবা সংশ্লিষ্ট ৭৬৪ জনের নাম ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। ২৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনটিতে ইয়াবা পাচার এর পেছনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উল্লেখ ছিল ওই সময়ের আওয়ামীলীগের দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলমের নাম।
সর্বশেষ গত ২০২২ সালের ডিসেম্বরের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ইয়াবা কারবারির সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ১২৭৫ জনকে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবদুর রহমান বদিই সীমান্তের ইয়াবা নিয়ন্ত্রক এবং সকল কারবারিরা তার নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হয়।
বদি কারাগারে থাকলে এরপর থেকে আলোচনায় আসছে সীমান্তের অন্যান্য ইয়াবা কারবারিরা কেমন আছেন এবং কোথায় আছেন? এমন প্রশ্ন।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, পুলিশ সহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ভাটা সহ নানা কারণে বহুল আলোচিত ইয়াবা ডন বদি কারাগারে থাকলেও থেমে নেই ইয়াবা পাচার ও এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি।
অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে চিহ্নিত শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলমের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে পুরোদমে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রেখেছে।
এর মধ্যে গত ১০দিনে পাঁচ লক্ষাধিক ইয়াবা, ৩ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস, বিদেশী পিস্তল উদ্ধার করে বিজিবি সদস্যরা। পৃথক অভিযানে র্যাব উদ্ধার করে আরও অন্তত দেড় লাখ ইয়াবা।
টেকনাফ সীমান্তের একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, পট পরিবর্তনেও মাদক পাচারে কোন প্রভাব পড়েনি সীমান্তে। বীরদর্পে ইয়াবা কারবার অব্যাহত রেখেছে চিহ্নিত কারবারিরা। এর মধ্যে নিজেকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে স্বীকার করে আত্মসমর্পনকারিরাও পুরোদমে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রেখেছে। আবার এদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সুবিধা আদায়ের জন্য বিএনপিতে যুক্ত হতে চেষ্টাও শুরু করেছে।
টেকনাফে একাধিক সরকারি-বেসরকারী ব্যক্তির দেয়া তথ্য মতে, সরকারের একটি পর একটি তালিকা প্রণয়ন, টেকনাফ থানায় ওসি হিসেবে প্রদীপ কুমার দাশের যোগদানের পর একের পর এক ক্রসফায়ারের নামে নিহত হওয়ার ঘটনা টেকনাফ আতংকের জনপদে পরিণত হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন, এবং ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন নিজেকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে স্বীকার করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন।
এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে ১০২ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি ও গডফাদার সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা, ৩০ টি দেশীয় তৈরি বন্দুক ও ৭০ রাউন্ড গুলিসহ আত্মসমর্পণ করেন। ওইদিনই আত্মসমর্পণকারী ১০২ জনকে আসামী করে টেকনাফ মডেল থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হয়। বাদী হয়ে মামলাটি করেন টেকনাফ থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) শরীফ ইবনে আলম। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় পরিদর্শক এবিএমএস দোহাকে। মামলা দায়েরের দিনই আদালতের মাধ্যমে সকল আসামীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। ১০২ জন আসামীর মধ্যে মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট মোহাম্মদ রাসেল নামে এক আসামী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্ন ফারাহ এর আদালত ১০১ আসামীর বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরবর্তীতে মামলাটি বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করা হয়। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল সকল আসামীর উপস্থিতিতে শুনানী শেষে মামলার চার্জ গঠন করেন। বিচার শেষে ২৩ নভেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
কিন্তু ওই রায়ে মাদক মামলায় প্রত্যককে ১ বছর ৬ মাসের কারাদন্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা প্রদান করা হয়। একই সঙ্গে অস্ত্র মামলায় সকলকে খালাসের আদেশ দেয় আদালত। এতে একজনকেও নতুন করে সাজা ভোগ করতে হয়নি। ঘোষিত রায়ে ১০১ আসামির হাজতবাস সাজার অধীনে হওয়ায় নতুন করে সাজা ভোগ করতে হয়নি। ফলে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে করা ২০ হাজার টাকা জরিমানা প্রতিশোধ করেই খালাস পেয়ে যান সকল মাদককারবারী।
এই রায়ের পর টেকনাফে ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে উল্লাস শুরু হয়। সকলেই বদি ও জাফরের তত্বাবধানে বীরদর্পে শুরু করেন পুরাতন কারবার। অনেকেই নতুন করে ইয়াবা সহ গ্রেপ্তারও হয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত তালিকায় ইয়াবা কারবারিরা চিহ্নিত থাকলেও কোনভাবেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীদের কারনে । এতে বর্তমান ও সাবেক সংসদের ভাই ও পুত্র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক দলের নেতা, পৌরসভার কাউন্সিলর, স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকের নামও রয়েছে। মুলত সরকারদলীয় সংসদ, তার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট আত্মীয়-স্বজনরাই ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে এদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলেই উল্টো হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশের দেওয়া তথ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় আব্দুর রহমান বদি ছাড়াও তার তিন ভাই আব্দুল আমিন, মৌলভী মুজিবুর রহমান, আব্দুস শুক্কুর, টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ ও তার পুত্র শাহজাহান, দিদার হোসেন, বদির ভাগনে মো. সাহেদ রহমান নিপু, আব্দুল আমিন, নুরুল আমিন, বদির ভাই শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, বদির ভাই ফয়সাল রহমান, এনামুল হক ওরফে এনাম মেম্বার, একরাম হোসেন, ছৈয়দ হোসেন, বদির বেয়াই সাহেদ কামাল ওরফে সাহেদ, মৌলভী বশির আহমদ, আব্দুর রহমান, মোজাম্মেল হক, জোবাইর হোসেন, নুরুল বশর ওরফে কাউন্সিলার নুরশাদ, বদির ফুপাত ভাই কামরুল হাসান রাসেল, জিয়াউর রহমান, মোহাম্মদ শাহ, নুরুল কবির, মারুফ বিন খলিল ওরফে বাবু, মোহাম্মদ ইউনুচ, ছৈয়দ হোসেন ওরফে ছৈয়দু, মোহাম্মদ জামাল ওরফে জামাল মেম্বার, মোহাম্মদ হোছাইন, মো. হাসান আব্দুল্লাহ, রেজাউল করিম ওরফে রেজাউল মেম্বার, মো. আবু তাহের, রমজান আলী, মোহাম্মদ আফছার, হাবিবুর রহমান ওরফে নুর হাবিব, শামসুল আলম ওরফে শামশু মেম্বার, মোহাম্মদ ইসমাঈল, আব্দুল গনি, মোহাম্মদ আলী, জামাল হোসেন, আব্দুল হামিদ, নজরুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে দানু, মোহাম্মদ সিরাজ, মোহাম্মদ আলম, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, হোসেন আলী, নুরুল কবির মিঝি, শাহ আজম, জাফর আহমেদ ওরফে জাফর, রুস্তম আলী, নুরুল আলম, শফি উল্লাহ, মো. জহুর আলম, মোহাম্মদ হুসাইন, মোহাম্মদ সিদ্দিক, রবিউল আলম, মঞ্জুর আলী, হামিদ হোসেন, মোহাম্মদ আলম, নুরুল আমিন, বোরহান উদ্দিন, ইমান হোসেন, মোহাম্মদ হারুন, শওকত আলম, হোছাইন আহম্মদ, মোহাম্মদ আইয়ুব, মো. আবু ছৈয়দ, মো. রহিম উল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক, মোহাম্মদ সেলিম, নুর মোহাম্মদ, বদির খালাত ভাই মং অং থেইন ওরফে মমচি, মোহাম্মদ হেলাল, বদিউর রহমান ওরফে বদুরান, ছৈয়দ আলী, মোহাম্মদ হাছন, নুরুল আলম, আব্দুল কুদ্দুস, আলী আহম্মেদ, আলমগীর ফয়সাল ওরফে লিটন, জাহাঙ্গীর আলম, নুরুল আলম, সামছুল আলম শামীম, মোহাম্মদ ইউনুচ, নুরুল আফসার ওরফে আফসার উদ্দিন, মোহাম্মদ শাহজাহান আনছারী, নুরুল হুদা, শাহ আলম, আব্দুর রহমান, ফরিদ আলম, মাহবুব আলম, রশিদ আহমেদ, মোহাম্মদ তৈয়ব, জাফর আলম, মোহাম্মদ হাশেম ওরফে আংকু, আবু তৈয়ব, আলী নেওয়াজ, মোহাম্মদ আইয়ুব, কামাল হোসেন, নুরুল বশর ওরফে কালাভাই, আব্দুল করিম ওরফে করিম মাঝি, দিল মোহাম্মদ, মো. সাকের মিয়া ওরফে সাকের মাঝি সহ অনেকেই রয়েছেন। যারা এখন পুরোদমে প্রকাশ্যে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলমসহ এদের আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণের বদি ও জাফরের ইয়াবা পাচারের কৌশল সহ নানা অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করে স্বয়ং জেলা পুলিশের ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মাদক পাচার রোধ করতে সময় পরিবর্তনের পর এদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি হয়ে পড়েছে।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শাহজাহানের পিতা জাফর সহ সিন্ডিকেটের অন্য সহযোগীদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান অব্যাহত আছে।
জাফরের ব্যবহৃত মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ মিলেনি।