স্বাধীনতা পর থেকে উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে চলছে ৩ ঐতিহ্যেবাহী পরিবার। ঘুরে ফিরে তাদের দখলে থেকে যায় রাজনীতির চালিকা শক্তির চাবিকাঠি। মাঝে মাঝে আরো কিছু পরিবারের উত্থান হলেও শাহজাহান চৌধুরী, আবদুর রহমান বদি ও জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী’র পরিবারের বাহিরের গিয়ে কেউ রাজনীতিতে সাফল্যতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। অন্যদের অবস্থান এই উত্থান, এই পতন। ফলে উখিয়া-টেকনাফের ৩ রাজনৈতিক পরিবারের সাম্রাজ্য দখলে নিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে চতুর্থ শক্তি!
এই ৩ পরিবার যুগ যুগ ধরে সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র থেকে শুরু করেই সব জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক পদ পদবী তাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের দখলে রেখেছেন কোন না কোন ভাবে। তাদের ডিঙিয়ে চতুর্থ শক্তির আবির্ভাব ঘটানোর জন্য অনেক জোট ও অনেক কৌশল এবং অনেক রাজনৈতিক মেরুকরণ হলেও তারা তেমন সফলতার মুখ দেখেনি। ফলে বাধ্য হয়ে উখিয়া-টেকনাফের বেশি ভাগ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এই পরিবার গুলোর অনুগত, অনুসারী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে রাজনীতির মাঠে বা ভোটের মাঠে ঠিকে আছেন। মধ্যেখানে সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী’র পরিবার ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক চৌধুরী’র পরিবার ভালো ভাবেই রাজনীতি মাঠ দখলের নিয়ে ছিলেন, কিন্তু সেটা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় আওয়ামী লীগ,বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী ছাড়া অন্য কোন দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। বাকী রাজনৈতিক দল গুলো কার্যক্রম নামসর্বস্ব!
উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নে শাহজাহান চৌধুরী জন্ম। তাঁর জন্ম তারিখ ১৯৫০ সালের ১৭ জুলাই। তিনি ৭০ দশক থেকে একাধারে জাতীয় সংসদের হুইপ, জাতীয় সংসদ সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বর্তমানে কক্সবাজার জেলা বিএনপি’র সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। মিষ্টি ভাষী এই কৌশলী রাজনীতিবিদ দীর্ঘ ৪ যুগ ধরে তার জনপ্রিয়তা সমান তালে ধরে রেখেছেন। কক্সবাজার জেলায় তিনি ছাড়া তার সমসাময়িক রাজনীতিবিদরা এখন আর কেউ ভোটের বা রাজনীতির মাঠে নেই। শাহজাহান চৌধুরীর ছোট ভাই এডভোকেট শাহজালাল চৌধুরী উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও শাহজালাল চৌধুরী কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির একাধিক বার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। পাশাপাশি তিনি কক্সবাজার জেলা জামায়াত ইসলামী’র সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সময়। তার অপর ছোট ভাই শাহ কামাল চৌধুরী টানা ৫ বার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার আরেক ভাই সরওয়ার জাহান চৌধুরী উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন এবং বর্তমানে উখিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। শাহজাহান চৌধুরীর ৫ ভাইয়ের মধ্যে ৪ ভাই রাজনীতিবিদ, ১ ভাই ব্যবসায়ী। এছাড়াও উখিয়া-টেকনাফে অনেক জনপ্রতিনিধি শাহজাহান চৌধুরীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে স্বাধীনতার পর থেকে নির্বাচিত হয়ে অতীতে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনও করছেন।
সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি’র পিতা হলেন এজাহার মিয়া কোম্পানি। তিনি টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি মূলত একজন ব্যবসায়ি। সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর হাত ধরে তার রাজনীতিতে আগমন ঘটে। রাজনীতিতে আসার পর তিনি টেকনাফ উপজেলা আধিপত্য বিস্তার করেন এবং অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এজাহার মিয়া কোম্পানি একাধিক বার টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার বড় পুত্র আবদুর রহমান বদি টানা ২ বারের সংসদ সদস্য এবং টেকনাফ পৌর সভার প্রশাসক ও চেয়ারম্যান ছিলেন। এজাহার মিয়া কোম্পানি পূত্রবধূ শাহীন আক্তারও টানা ২ বারের বর্তমান সংসদ সদস্য। তার ছোট ভাই মোহাম্মদ ইসলাম টেকনাফ পৌর সভার টানা ২ বারের বর্তমান মেয়র। ছোট ছেলে মুজিবুর রহমান টেকনাফ পৌর সভার বর্তমান কাউন্সিলর, মেয়ের জামাতা শওকত আলী টেকনাফ বাহারছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। এজাহার মিয়া কোম্পানি দেশের আলোচিত সমালোচিত একজন ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ হলেও দানশীল ব্যক্তি হিসাবে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তার বড় পুত্র সাবেক সংসদ সদস্য ও টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান বদিরও দানশীল হিসাবে জেলাব্যাপী সুখ্যাতি রয়েছেন। এদিকে ভোটের রাজনীতিতে তো সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি অদ্বিতীয়। তার রাজনৈতিক ক্যারিশমা ও ম্যাজিকে বারবার পরাস্ত হচ্ছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষরা।
জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর পিতা হলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী (ঠান্ডা মিয়া)। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের তার জন্ম। পেশা তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন। পরে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। একজন নীতিবান সমাজ সেবক ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নুরুল ইসলাম চৌধুরী রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার ২ মেয়ের জামাই সাবেক সংসদ সদস্য। নুরুল ইসলাম চৌধুরীর বড় মেয়ে জামাই হলেন সাবেক সংসদ সদস্য আলমগীর মোহাম্মদ মাহফুজল্লাহ ফরিদ। তিনি টানা ২ বার সংসদ সদস্য ছিলেন। তার ছোট মেয়ের জামাই হলেন সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। তিনিও উখিয়া টেকনাফ আসনের ২ বারের সংসদ সদস্য ছিলেন। আবদুর রহমান বদির স্ত্রী (নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট মেয়ে) শাহিন আক্তারও টানা ২ বারের বর্তমান সংসদ সদস্য। অর্থাৎ : নুরুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবারেরই সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে তিন তিন জন সংসদ সদস্য। নুরুল ইসলাম চৌধুরী বড় ছেলে অধ্যাপক হুমায়ুন কবির চৌধুরী কক্সবাজার জেলা পরিষদের বর্তমান সদস্য। ছোট ছেলে জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের টানা তিন বারের বর্তমান চেয়ারম্যান। পাশাপাশি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী একযুগের বেশি সময় ধরে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী দ্বাদশ জতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন। নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী উখিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী (সিস্টার ইন ল’)ছেনুয়ারা বেগমও উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমান সময়ে জেলার অন্যতম সমৃদ্ধ রাজনৈতিক পরিবার হলো নুরুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবার। যে পরিবারে বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে তিন তিন জন সংসদ সদস্য।
সচেতন মহলের মতে, উখিয়া-টেকনাফের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ শাহজাহান চৌধুরী, নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও এজাহার মিয়া কোম্পানি’র পরিবারে দখলে প্রায় দীর্ঘ ৪ যুগধরে। ক্ষমতার পালাবদল হলেও ঘুরে ফিরে সকল জনপ্রতিনিধি তাদের আশীর্বাদপুষ্টরাই নির্বাচিত হয়। এই ৩ পরিবারের সফলতার ধারে কাছে কেউ যেতে পারতেছে না। যারা যাওয়ার চেষ্টা করেন তারাও বিভিন্ন কারনে রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে না। ফলে বারবার অক্ষত থেকে যাচ্ছে ৩ পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতার সাম্রাজ্য।