শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ পূর্বাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

ডিসেম্বরেই চালু হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’—নদীর দু’কূলে উৎসবের আমেজ

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২

চলতি বছরের ডিসেম্বরেই চালু হতে যাচ্ছে মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু টানেল। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন টানেলের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাই যতোই দিন ঘনিয়ে আসছে টানেল ঘিরে পদ্মা সেতুর পর আরেক ধামাকা উৎসবের আমেজ বইছে চট্টগ্রামজুড়ে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও টানেল নিয়ে লেখালেখির কমতি নেই। ফেসবুক ওয়ালেও শোভা পাচ্ছে টানেলের ছবি।

বঙ্গবন্ধু টানেলটি পতেঙ্গা প্রান্তে চট্টগ্রাম শহরের সাথে যুক্ত হবে আনোয়ারার মধ্যদিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম। ফলে পাল্টে যাচ্ছে আনোয়ারা ও আশপাশের উপজেলাবাসীর জীবনযাত্রার মান। একের পর এক খুলছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। বাড়ছে টানেল সংযুক্ত সড়কের আশেপাশের জমির দাম। গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা।

শিল্প কারখানা
টানেলকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ইকোনমিক জোনসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। ইতিমধ্যে আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), বেসরকারিখাতে সবচেয়ে বড় সার কারখানা (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে (সিইউএফএল), সা’দ মুছা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্কের মতো পুরনো কারখানাগুলোর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।

এছাড়াও বঙ্গবন্ধু টানেলের অ্যাপ্রোচ রোডের কাছাকাছি এলাকায় প্রায় এক একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে বিশাল পোশাক কারখানা এইচএস কম্পোজিড টেক্সটাইল। আশা করা হচ্ছে এই পোশাক কারখানায় তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় কারখানা স্থাপনের লক্ষে জমি ক্রয় করেছে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপসহ ফোরএইচ গ্রুপ, ডায়মন্ড সিমেন্ট, এস আলম গ্রুপ ও পারটেক্স গ্রুপ।

বাড়ছে জমির দাম
বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে ইতিমধ্যে আনোয়ারার জায়গা জমির দাম বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে টানেল সংযুক্ত সড়কের আশপাশের এলাকার জমি দাম বছরের ব্যবধানে বেড়েছে কয়েকগুণ। বৈরাগ, চাতরী, বারশত, বটতলী এলাকার জমি বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। তবুও থেমে নেই জমি বেচাকেনা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে জমি কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা।

পাল্টে যাচ্ছে সামাজিক অবস্থান
টানেলকে ঘিরে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠার পাশাপাশি ঘিরে নামি-দামি হোটেল-রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে আনোয়ারায়।
উপজেলার বন্দর কমিউনিটি সেন্টার, সিইউএফএল, চৌমুহনী, বটতলী, কালাবিবির দিঘির মোড়ে অসংখ্য হোটেল-রেস্টুরেন্ট নির্মাণের তোড়জোড় চলছে। পাল্টে যাচ্ছে এ এলাকার অনেক জায়গায় নাম। যেমনি কিছুদিন আগে গোয়ালপাড়ার নামকরণ করা হয়েছে ‘টানেল নগর’।

পর্যটন শিল্পে আমূল পরিবর্তন
টানেলের আশেপাশে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটন স্পট। পাশাপাশি পুরনো বিনোদন কেন্দ্রগুলোর উন্নয়নে আসছে নতুন বাজেট। পারকি সমুদ্র সৈকতে পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্বমানের পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া বটতলীতে তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সুন্দর্যের সমন্বয়ে মেন্না গার্ডেন নামের নতুন বিনোদন কেন্দ্র। যা ইতোমধ্যে সকল পর্যটকের কাছে জনপ্রিয় বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এছাড়াও উপজেলায় রয়েছে প্যারাবন, হিলটপ পার্ক, ১৫ নং ঘাট, মেরিন একাডেমিসহ মনোমুগ্ধকর নানান পর্যটনকেন্দ্র।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভাবনীয় পরিবর্তন
টানেলের সংযোগ সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ৩৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলীর শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার সড়ক ছয় লাইনে উন্নীত করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সড়কের দুইপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বালি ভরাট ও কালভার্ট নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে।

টানেল সংযোগ সড়কে পর্যটকের ভিড়
প্রতিদিন বিকেল হলেই আনোয়ারা, কর্ণফুলী, পটিয়াসহ আশেপাশের সব উপজেলা থেকে টানেল সংযোগ সড়কে এসে ভিড় জমান দর্শনার্থীরা। সংযোগ সড়কের আকর্ষণীয় কারুকাজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেই আকৃষ্ট হয়ে এই সড়কে আসেন তারা। ছুটির দিনে সুন্দর একটা বিকেল কাটাতে এই সড়কটিকেই এখন বেছে নিয়েছে অনেকেই।

বঙ্গবন্ধু টানেল ও সংযোগ সড়কের সর্বশেষ তথ্য
টানেলের কাজ ৮৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়াতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল টানেল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। অতিরিক্ত আরও ৬ মাস সময় দীর্ঘায়িত হলে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় হবে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। তবে প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলটি চালুর লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে কাজ করছেন তারা। টানেলের মূল কাজের সাথে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য জেনারেটর স্থাপন, বাতাস ও অক্সিজেন পরিবহনের প্রযুক্তি স্থাপন, ডেকোরেটিভ ওয়াল, ফায়ার ওয়াল, ওপেন কাট এরিয়া, ছাউনিসহ কেবল লাইন ও লাইটিংয়ের কাজও চলছে।

টানেলকে ঘিরে আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটারের একটি ফ্লাইওভারের কাজসহ চার লাইনের ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক প্রস্তুতির কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।

এ বিষয়ে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, টানেলকে ঘিরে চট্টগ্রামের আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। সেই সাথে বাড়ছে উপজেলার জায়গা জমির দাম। টানেল নির্মাণের ফলে অর্থনীতির এক নতুন দুয়ার উন্মোচন হচ্ছে।

সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। ইতিমধ্যে ১৫টি কালভার্টসহ প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ শেষ পর্যায়ে। সেইসাথে আনোয়ারা প্রান্তে যানবাহন যাতে আরও দ্রুত এবং কম সময়ে কক্সবাজার পৌঁছাতে পারে, ক্রসিং থেকে পটিয়া পর্যন্ত সড়কটি ১৮ ফুট থেকে ৩৪ ফুটে উন্নীত করে অতিরিক্ত বাঁকগুলো সোজা করার কাজও চলছে।

কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশিদ বলেন, টানেলের ৮৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। প্রয়োজনীয় লাইটিং, অক্সিজেন সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় বিউটিফিকেশন কাজসহ বাকি কাজগুলো আমরা দ্রুততার সাথে শেষ করার চেষ্টা করছি। উভয় পাশের সংযোগ সড়কের কাজও সমানতালে চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলটি চালুর লক্ষমাত্রা সামনে রেখে কাজ করছি। তবে টানেলের অভ্যন্তরে কমিউনিকেশন সিস্টেমসহ ভেন্টিলেশন ও অন্যান্য কাজের সরঞ্জাম চীন থেকে আনতে একটু বিলম্ব হচ্ছে।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং টানেল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। নির্মাণ কাজ শেষ হলে এটিই হবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত সুড়ঙ্গ পথ।


আরো খবর: