সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৩ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

গড়ে ৯০ টাকা কেজির খেজুর বাজারে ১৮শ

প্রতিবেদকের নাম:
আপডেট: সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০২৩


চট্টগ্রাম, ২৭ মার্চ – চট্টগ্রামের বড় আমদানিকারক ‘আল্লাহর রহমত স্টোর’। রমজান উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটি ১৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় ২ হাজার ৫০২ টন খেজুর এনেছে। কেজিতে খরচ পড়েছে ৭০ টাকা ৫৩ পয়সা। একইভাবে ‘কচমচ এন্টারপ্রাইজ’ ৬৬ টাকা কেজি দরে ২৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকায় ৩ হাজার ৬১০ ও ঢাকার গুলশানের বড় আমদানিকারক মদিনা গ্রুপ ১০০ টাকা দরে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৬২ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় আমদানি করেছে ৬ হাজার ১৭৮ টন খেজুর। এর মধ্যে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আমদানিকারকরা ৮০ টাকা ১১ পয়সা দরে ৭৫ কোটি ৪২ লাখ টাকায় ৯ হাজার ৪১৪ টন খেজুর এনেছেন। আমদানি নথি বিশ্লেষণে এমন দর মিললেও দেশের বাজারে কোথাও ২৫০ টাকার নিচে খেজুর নেই। সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যেক রমজানে দেশে খেজুরের চাহিদা বেড়ে যায়। একে পুঁজি করে আমদানিকারকরা দামে ভয়ংকর কারসাজি করেন। এবার তাঁরা খেজুরভেদে কেজিতে ৩ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত মুনাফা করছেন। আর দাম সিন্ডিকেটে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিনের যোগসাজশ পেয়েছে স্বয়ং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম ও নুর উদ্দিনের মোবাইল ফোন নম্বরে কল দিলেও রিসিভ হয়নি। পরে দোকানে গিয়েও তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে পদে পদে মিথ্যার বেসাতি করেন আমদানিকারকরা। রমজান উপলক্ষে ২৮ ধরনের খেজুর আমদানি হলেও কাস্টমস শুল্কায়নে সব খেজুরের মান নিম্ন এবং দাম এক। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশ কর ফাঁকি দেওয়া হয়। তবে বন্দর থেকে খালাসের পরই পাল্টে যায় চিত্র। উন্নত, মাঝারি ও নিম্ন– তিনটি ক্যাটাগরিতে বিক্রি করে বাজার থেকে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে ১১ হাজার ১৩১ টন খেজুর এসেছে, প্রতি কেজির আমদানি মূল্য ৮০ টাকা ২০ পয়সা। আগের মাসে ৯২ টাকা ৯১ পয়সা দরে আসে ৭ হাজার ৬৮২ টন খেজুর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর আমদানির তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে, এ সময় দেশে ৫০ হাজার ২৫৭ টন খেজুর এসেছে। ৪৭৭ কোটি ২৮ লাখ টাকায় আনা এসব খেজুরের দাম পড়েছে কেজিতে গড়ে ৯৪ টাকা ৯৬ পয়সা। চলতি অর্থবছরে ২৮ ধরনের খেজুর এলেও সবগুলো একটি এইচএস কোড (পণ্য শনাক্তকরণ নম্বর) মূলে শুল্কায়ন করেছেন আমদানিকারকরা। আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি মার্চে দাম আরও কমে যাওয়ায় এখন সব খেজুরের গড়মূল্য দেখা যাচ্ছে ৮৯ টাকা ৩৬ পয়সা। কিন্তু বাজারে ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার ৮০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে খেজুর। এ হিসাবে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি দাম নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন যোগসাজশ করে আমদানিকারক এবং কমিশন এজেন্টদের মধ্যে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে চড়া দামে দেশে খেজুর বিক্রি করছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানেও এ চক্রের দাম কারসাজির সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘খেজুরের বাজারে ভয়ংকর জালিয়াতি চলছে। উচ্চমূল্যের খেজুর নিম্নদামের ঘোষণা দিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করছেন কিছু আমদানিকারক। এর মাধ্যমে তাঁরা সরকারকেও রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। তিন পদ্ধতিতে খেজুর বাছাই করে ভোক্তার পকেট কাটছেন ব্যবসায়ীরা। দাম কারসাজিতে সিরাজুল ও নুরের যোগসাজশ মিলেছে, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রামের আরেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, ‘অ্যারাবিয়ান ফ্রুটস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তাঁর দোকানে বেশি দামে খেজুর বিক্রির প্রমাণ পেয়েছি। তাঁরা ২৫ থেকে ২৮ ধরনের ৯ হাজার ২১১ টন খেজুর আনলেও সব ক’টি একটি এইচএস কোডের বিপরীতে শুল্কায়ন করেছে। প্রতি কেজি খেজুরের আমদানি মূল্য মাত্র ৮৪ দশমিক ৬৪ টাকা হলেও সিরাজুল ইসলামের দোকানে হাজার টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।’

ইরাকের জাহিদি খেজুরের চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি দাম মিসরের মেজডুলের। কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টমসে আমদানিকারকরা সব খেজুরের দাম এক ঘোষণায় এনে উচ্চ হারের শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো খেজুরের দাম ১০০ টাকা হলে কাস্টমসে তার শুল্কায়ন হবে আমদানি মূল্যের ওপর। ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক হার নির্ধারিত রয়েছে। এখন ৩০০ টাকার পণ্যও ১০০ টাকা ঘোষণা করা হলে শুল্ক হারে কোনো পরিবর্তন আসে না। মাঝে শুল্ক বঞ্চিত হয় সরকার।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইরাকের জাহিদি ছাড়াও বাংলাদেশে বেশি বিক্রি হয় আমিরাত গোল্ড। এটির দাম জাহিদির চেয়ে তুলনামূলক বেশি। নাগাল, রেজিস, দাব্বাস ও লুলু খেজুরও আসে আমিরাত থেকে। দুবাইয়ের লুলু, মদিনার মাশরুক, মরিয়ম, কালমি, সাফাওয়িসহ ২৮ রকমের খেজুর এ দেশে আসে।

মুনাফার ফাঁদ পাইকারি মোকামেও: চট্টগ্রামে ফলের পাইকারি আড়ত রেলওয়ের ফলমুণ্ডিতে। আড়তের আমদানিকারকরা এবার ২০ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় ২ হাজার ৭৬৪ টন খেজুর এনেছেন। প্রতি কেজিতে খরচ হয়েছে ৭৪ টাকা ৫ পয়সা। ফলের আরেকটি মোকাম খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের আমদানিকারকরা এবার ১০০ টাকা ১৮ পয়সা দরে ১৬ কোটি ৯০ লাখ টাকায় ১ হাজার ৬৮৬ টন খেজুর এনেছেন। আর চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকার আমদানিকারকরা ৭৪ টাকা ৭৪ পয়সা দরে ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় ৪ হাজার ৬৭৬ টন খেজুর এনেছেন। কিন্তু চট্টগ্রামের কোথাও এর কাছাকাছি দামে মিলছে না খেজুর। সর্বনিম্ন ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ফলমুণ্ডির আড়তে অবিশ্বাস্য মুনাফার প্রমাণ পেয়েছেন। পাইকারি এ মোকামে আজওয়া ৭৫০ থেকে ১ হাজার, মাবরুম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০, মরিয়ম ৫০০ থেকে ৮০০, দাবাস ৪০০ থেকে ৬০০, জাহিদি ২৫০, মেজডুল ১২০০ থেকে ১৩০০, আলজেরিয়া খেজুর ২৫০ থেকে ৪০০ ও ভালো মানের মেজডুল ১ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব খেজুর খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি আরও ১০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি। অভিযানে দাম কারসাজির কারণে ফলমুণ্ডির আল্লাহর রহমত স্টোরকে সম্প্রতি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এ ধরনের মুনাফাকে ক্রেতার সঙ্গে ‘প্রতারণা’ উল্লেখ করে ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘রমজানে চাহিদা বৃদ্ধিকে পুঁজি করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী খেজুরে অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন। আগেভাগে তাঁদের নজরদারিতে আনা গেলে ভোক্তারা স্বস্তি পেতেন।’

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/২৭ মার্চ ২০২৩


আরো খবর: