প্রথম আলো::
দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ ওঠা ১০১ জনের সম্পদ অনুসন্ধান ঝুলে আছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে তাঁদের অবৈধ সম্পদের তথ্য পান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সদ্য চাকরি হারানো কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানসহ ৯৬ জন। আর চট্টগ্রামের রয়েছেন চিকিৎসক নেতা শেখ শফিউল আজমসহ ৫ জন। এ ছাড়া রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও ব্যাংকার।
দুদকের উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন গত বছরের ৩০ জুন চট্টগ্রাম থেকে বদলির আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সম্পদের প্রাথমিক অনুসন্ধানের আবেদন করেছিলেন প্রধান কার্যালয়ে। সাত মাস পেরিয়ে গেলেও সেই আবেদনের কোনো কিনারা হয়নি। অপর দিকে ১৬ ফেব্রুয়ারি শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করে দুদক।
শরীফ উদ্দিন গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারের দুর্নীতির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লেনদেন, জমির ভুয়া মালিকানা সেজে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা আত্মসাতে তাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এ ছাড়া অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকারীদের তথ্য উঠে আসে। এ জন্য তাঁদের সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য সুপারিশ করা হয়।
শরীফ উদ্দিন বলেন, কক্সবাজারের দুর্নীতির ঘটনায় দুই ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে আদালতে আবেদন করার জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও অনুমোদন পাওয়া যায় দেরিতে। এর মধ্যে ওই ব্যক্তিরা টাকা তুলে নেন।
দুদক সূত্র জানায়, শরীফ উদ্দিন মোট ১৩৮ জনের সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য দুদকে সুপারিশ করেছিলেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ও স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং রেলওয়ের ‘খালাসি’ পদে ১৯ জনকে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমদেসহ ৩৭ জনের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এটি এখনো চলমান।
এ ছাড়া চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য খাতের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতির অভিযোগে বিএমএ কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা শেখ শফিউল আজমসহ পাঁচজনের সম্পদ অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছিলেন শরীফ উদ্দিন। কিন্তু সেটা আর এগোয়নি। যদিও শেখ শফিউল আজম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। দুদক ডাকার পর তিনি সবকিছু জানিয়েছেন।
কক্সবাজারের ৯৬ জন
কক্সবাজারে সরকার সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ৭৩টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প, কক্সবাজার শহরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও সিআইডির কার্যালয় নির্মাণ এবং মহেশখালীতে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) নির্মাণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে জালজালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় দুদক।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনটি প্রকল্পেই জমির ক্ষতিপূরণের টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি দালাল চক্র সক্রিয় ছিল। তারা ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ কমিশন হিসেবে নিত, যা দালাল চক্রের হাত দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। কিন্তু শরীফের দেওয়া প্রতিবেদন দুদক গ্রহণ না করে তা পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
শরীফ উদ্দিন প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে ৯৬ জনের সম্পৃক্ততা পান। এর মধ্যে রয়েছেন পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, তাঁর ছেলে হাসান মেহেদী রহমান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সিরাজুম মোস্তফা, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসেদুল হক, পৌরসভার কাউন্সিলর মিজানুর রহমান, কাউন্সিলর ওমর সিদ্দিক, সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ মোহাম্মদ কায়সার, মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান, ধলঘাটের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম, মাতারবাড়ী ইউনিয়নের রুহুল আমিনসহ স্থানীয় ১৭ জন রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখাসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে টাকা লেনদেনে জড়িত ৫৮ জনের সম্পৃক্ততা পায় দুদক। তাঁরা দালাল হিসেবে কাজ করতেন। এসব দালালের বাইরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, মহেশখালীর ইউনিয়ন পরিষদ ও কক্সবাজার পৌরসভার সচিবসহ সরকারি চাকরিজীবী ছয়জন, স্থানীয় পাঁচজন সাংবাদিক, আইনজীবী আটজন ও দুজন ব্যাংকারের নাম অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।
কক্সবাজারের তিন প্রকল্পে শরীফের করা অভিযোগপত্রের সুপারিশ বাতিল করে সেটা পুনঃ তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে বলে জানান দুদকের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখানে সবে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কাগজ, নথিপত্র সব বুঝে নিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে দুদক দুর্নীতিবাজ কাউকে ছাড় দেবে না।
২০১৮ সাল থেকে এসব প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এলএ শাখার সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খান আটকের পর ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ পেতে থাকে। এরপর দুদক তদন্তে নামে। এই ঘটনায় করা মামলায় তখন ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
তবে কক্সবাজারের ঘটনায় যে ৯৬ জনের সম্পদের অনুসন্ধান করার সুপারিশ করেছিলেন শরীফ, সেই বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দুদক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামে দুদকের পরিচালক মাহমুদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে করা হবে।
দেরিতে অনুমোদন
কক্সবাজারে একটি প্রকল্পে জালজালিয়াতির মাধ্যমে বেলায়েত হোসেন নামের এক ব্যক্তি ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে তথ্য পান শরীফ উদ্দিন। তাঁর ব্যাংক হিসাবে থাকা ৫০ লাখ টাকাসহ যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের অনুমোদনের জন্য ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু সেটির অনুমোদন হয় ছয় মাস পর ৩০ জুন। তবে ক্রোকের জন্য দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে কোনো আবেদন করা হয়নি। একইভাবে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমানের শ্যালক মো. মিজানুর রহমানের ব্যাংক হিসাবে থাকা ৪ কোটি টাকা (এফডিআর) যাতে তুলতে না পারেন, সে জন্য হিসাব স্থগিতের অনুমোদনের চিঠিও আসে দেরিতে। এর আগেই টাকা তুলে নেন মিজানুর রহমান।
দুর্নীতিবাজদের স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের অনুসন্ধান না হলে তাঁরা আরও উৎসাহী হবে বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজারের সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সম্পদের অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র। তাঁদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত।