রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২৪ অপরাহ্ন
নোটিশ::
কক্সবাজার পোস্ট ডটকমে আপনাকে স্বাগতম..  

উখিয়া মধুরছড়ার ২০ একর বনভূমি কার দখলে?

সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার :
আপডেট: রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪

সালটি ছিলো ২০১৫। রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সংসদ সদস্য সরকারী দলের মনোনীত আবদুর রহমান বদি। উখিয়া সদর রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী। এই তিন ক্ষমতার সমন্বয়ে এপ্রিল মাসে হঠাৎ করে রাতের অন্ধকারে কক্সবাজারের উখিয়ার আলোচিত মধুরছড়ায় সেই দুর্গম পাহাড়ের জঙ্গি অর্থায়নে গড়ে তোলা অর্ধশতাধিক রহস্যময় স্থাপনা। সাথে দখলে নেওয়ার হয় প্রায় ১৫ একর সরকারি বনভূমি জায়গা। স্থাপনা উচ্ছেদ হলেও অবৈধ ভাবে দখল হওয়া সরকারি সম্পত্তি আজ দীর্ঘ ৯ বছর অতিবাহিত হলেও রহস্য জনক কারণে উদ্ধারের চেষ্টা করেনি বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এমনকি হয়নি বনভূমি দখলকারী মূলহোতাদের বিরুদ্ধে মামলাও। এই বিষয়ে স্থানীয় সচেতন জনসাধারণকে কৌশলে রাখা হয়েছে অন্ধকারে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ডাব্লিউএফপি সহ বিভিন্ন প্রভাবশারীদের দখলে থাকা মধুরছড়া এলাকার বনভূমি উদ্ধার চায় স্থানীয় সচেতন মহল।

২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে উখিয়ার মধুরছড়ায় কি ঘটে ছিলো :
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রাজাপালং পালং ইউনিয়নের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের পাশের পাহাড়ি বনভূমিতে ‘রাতারাতি’ গড়ে তোলা হয়ে ছিলো কিছু রহস্যময় স্থাপনা। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলোর মধ্যে ছিলো ৪০টি সেমিপাকা ঘর, মসজিদ ও হাসপাতাল। সব মিলিয়ে রীতিমতো একটি কমপ্লেক্স।

গহিন পাহাড়ি এলাকায় এত নির্মাণসামগ্রী এনে বন বিভাগসহ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে কিভাবে এতগুলো অবৈধ স্থাপনা রাতারাতি তৈরি হয়ে গেল তাও কেউ জানতো না । তবে নির্মাণকাজ হয়ে ছিলো সশস্ত্র পাহারায়। এই স্থাপনা গুলো নির্মাণ করা হয়ে ছিলো জঙ্গি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলার জন্য । আর তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলো মধ্য এশিয়াভিত্তিক একটি এনজিও, যাদের নামে আগে থেকেই জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ছিলো।

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের ঘুনধুম পয়েন্ট থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে মাছকারিয়া বনভূমিতে গাছপালা কেটে গড়ে তোলা হয়ে ছিলো এসব স্থাপনা। এই কমপ্লেক্সের অদূরেই ছিলো রোহিঙ্গাদের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত দুটি আশ্রয়শিবির।

আশপাশের এলাকাবাসীরও অভিযোগ ছিলো, জঙ্গি অর্থায়নেই সরকারি বনভূমি দখল করে এসব ‘রহস্যময় অবকাঠামো’ গড়ে তোলা হয়েছিলো, কমপক্ষে পাঁচ-ছয় কোটি টাকার গোপন প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।

রহস্যঘেরা এ কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজে সরাসরি জড়িত ছিলো উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির শ্যালক, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া সদর বনবিটের আওতাধীন মাছকারিয়া বনভূমির কমপক্ষে ১৫ একর জমি দখলে নিয়ে এসব রহস্যঘেরা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এলাকাটিতে দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানইজেশনের (আরএসও) লোকজনের যাতায়াত ছিলো। আরএসওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়াভিত্তিক এনজিওর ছদ্মাবরণে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের। আনরেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শিবিরের রোহিঙ্গাদের মধুরছড়া এবং মাছকারিয়া বনভূমিতে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও হতো। সেখান থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর তাদের নেওয়া হতো বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কুলাচি, দুছড়ি এবং মিয়ানমার সীমান্তবর্তী আরএসওর সামরিক ট্রেনিং ক্যাম্পে।

জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যম বিষয়টি একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চার শতাধিক সদস্য নিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে যৌথ-বাহিনী মধুরছড়ার এই রহস্যময় স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করতে গিয়েছিল। এ সময় তারা জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর সমর্থিত সশস্ত্র লোকজনের বাঁধার মুখে পড়ে। তারা রহস্যময় স্থাপনাগুলো অক্ষত রাখতে পাহাড়ে যাতায়াতের রাস্তা পর্যন্ত কেটে দেওয়া হয়ে ছিলো তখন। প্রতিরোধে গেলে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কায় ওই সময় উচ্ছেদ না করেই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ৪ শতাধিক এর বিশাল টীম। উক্ত সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২০ জন সদস্য দুষ্কৃতিকারীদের হামলায় আহত হন। এই ঘটনায় ৯২/উখি অব ২০১৪-১৫ তাং- ০৩/০৪/১৫ ( মধুরছড়া) একটি মামলা হলে সেখানে ঘটনার মূল নেতৃত্ব দানকারী জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীসহ তার লালিত সন্ত্রাসী বাহিনীর কেউ আসামি হয়নি। শুধু মাত্র শুকুর, নুরুল ইসলাম ও দেলোয়ার নামে ৩ জনকে আসামি করা হয় ছিলো।

শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি ঘটনাস্থলে এসে হস্তক্ষেপ করেন। ওইদিন তিনি যৌথ বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বসে স্থাপনাগুলো স্ব-উদ্যোগে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এক সপ্তাহের সময় চান। সেই সঙ্গে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পাহাড়ের ভিতর এ রকম পরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের অর্থায়নের রহস্যও জানাবেন বলে কথা দেন। এসব কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হয় তৎকালীন প্রশাসনের পক্ষ থেকে । কিন্তু এক সপ্তাহের স্থগিতের কথা বলে দীর্ঘ প্রায় দু`মাস স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ না করায় নানা কথা উঠে।

তারা অভিযোগ তুলে ছিলো, ১৫/২০ একর সরকারি বনভূমি দখল করে জঙ্গী সম্পৃক্ত বিদেশি এনজিও`র অর্থায়নে অর্ধ-শতাধিক সেমিপাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এর আগেও একই এলাকায় জঙ্গী সম্পৃক্ত এনজিও`র অর্থায়নে এ রকম স্থাপনা করা হয়েছিল। সাংসদ বদির শ্যালক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী আন্তর্জাতিক কয়েকটি এনজিও`র ২৬ কোটি টাকার অনুদানে দুর্গম পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণের জন্য এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে সহায়তা দেন। এসব স্থাপনা নির্মাণে তার ইটভাটা থেকেই ইট সরবরাহ করা হয়ে ছিল।

অর্থ যোগানদাতা ছিলো কে?
মধুরছড়া এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, সরকারী জায়গা দখল করে বিদেশী অর্থায়নে অসংখ্য দালান নির্মাণ, উচ্ছেদে যাওয়া সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া এবং এপর্যন্তও ওইসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং গ্রেফতার না হওয়ার নেপথ্যে প্রভাবশালীদের অবৈধ প্রভাব রয়েছে। রোহিঙ্গা দরদী হয়ে জঙ্গী কর্মকান্ডে মদদ যোগানো এবং সন্দেহ ভাজন কর্মকান্ডে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে উৎসাহ দিয়ে ছিলো কারা সেটা সবাই জানতো, কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি এতোদিন কেউ? কক্সবাজারে বসবাসকারী জোবাইর নামে এক যুবক চাকরি করতেন তুরস্কভিত্তিক একটি এনজিও সংস্থায়। এক সময়ের বিএনপি নেতা আবুল কাশেম ও তার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা মফিজ উদ্দিন তাদের ভাগিনা জোবাইরের মাধ্যমে বিদেশী একটি অর্থ যোগানদাতা সংস্থা থেকে কোটি কোটি টাকা এনে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়ে ছিলো বলে তথ্য মিলেছে। আর ঐ অর্থের একটি মোটা অঙ্কের ভাগ পেয়ে ছিলো এক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলীয় প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ ও সরকারি কর্মকর্তারা।

এলাকাবাসীর মতে, যদিওবা রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল কিন্তু সেখানে দাতা সংস্থা এনজিওর পক্ষ থেকে সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন বর্তমানে মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল এনজিওর সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জুবায়ের ও নির্বাহী সদস্য (পরিচালক) লায়লা বেগম। স্থানীয়দের দাবি এসব স্থাপনা নির্মাণের জন্য জঙ্গি সম্পৃক্ত  দাতা এনজিওর অর্থ জোগাড় করতেন মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল এর প্রধান নির্বাহী মোঃ জুবায়ের ও পরিচালক লায়লা বেগম আর স্থানীয়ভাবে  তদারিকের দায়িত্ব ছিলেন জুবায়ের এর আপন মামা রাজা পালং ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজ মিয়া প্রকাশ মফিজ কন্ট্রাক্টর।

সাধারণের যাতায়াতে বাধা:
উখিয়ার সেই বহুল আলোচিত মধুরছড়া-মাছকারিয়া সরকারী বনভূমিতে অবৈধভাবে গড়ে তোলা রহস্যময় স্থাপনাগুলোর কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, ঐ পাহাড়ের পাদদেশে সাধারণ কারও যাতায়াতের ওপর নিষেধ রয়েছে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের। দিনের বেলায় কেউ সেখানে গেলে তার পরিচয়, কি কাজে এবং কার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন ইত্যাদি জেনে মুঠোফোনে ডেকে কাক্ষিত ব্যক্তিকে প্রধান ফটকে এনে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হতো। টেকনাফের স্থানীয় সাংবাদিক ও যুবলীগ নেতা নজির আহমদ সীমান্ত ঐএলাকা সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর সন্ত্রাসী বাহিনী হাতে মারধরের শিকার হয়ে ছিলো।

জঙ্গীদের নিরাপদ আড্ডাস্থল মধুরছড়া পাহাড় :-
মধুরছড়া পাহাড়কে নিরাপদ আস্তানা হিসেবে চিন্তা ভাবনায় এনে আরাকান বিদ্রোহী সংগঠন আরএসওসহ আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীর অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়ে থাকেন বলে অভিযাগ রয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। চিহ্নিত জঙ্গী ও সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা যারা নাশকতা কাজে জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে অর্থের বিনিময়ে ভাড়ায় গিয়ে বেআইনী কাজে অংশ নেয়, তারাই মধুরছড়া পাহাড়কে নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে প্রায় সময়।

তৎকালীন সরকারি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য যেমন ছিলো :
আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলে ছিলেন, ‘আমার ইউনিয়নের দুই তৃতীয়াংশ এলাকাই বনভূমি। তাই বনভূমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ ছাড়া কোনো গন্তব্য নেই। মাছকারিয়া এলাকার মাত্র কয়েক একর বনভূমিতে নতুন যে ঘরগুলো হচ্ছে এগুলো সবই ভূমিহীনদের। আমরা তাদের সহযোগিতা করছি।’

ভূমিহীনদের এ রকম সেমিপাকা ঘর নির্মাণের টাকার উৎসের বিষয়ে তিনি বলে ছিলেন, ‘তাদের সমিতি রয়েছে এবং টাকা-পয়সাও আছে।’

এই কমপ্লেক্সের পেছনে বিদেশি এনজিও এবং জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং আপনার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি জানিয়ে ছিলেন ‘আমার পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক শত্রু রয়েছে। তাই অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারেন।’

সরকারি বনভূমি দখলে নিয়ে রহস্যময় স্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল সরকার বলে ছিলেন, ‘বন বিভাগের জমি দখল করে অল্প কদিনের মধ্যেই এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। আমার অধীনস্থ বন কর্মীরা ঘটনাস্থলের গেলেও এই অবকাঠামো নির্মাণকাজে জড়িতদের সশস্ত্র পাহারার কারণে একদম কাছে যেতে পারেননি।’
‘এখানকার অত্যন্ত উদ্বেগজনক কথা আমি শুনেছি। স্পর্শকাতর বিষয়টি আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বনভূমি দখলের ঘটনায় স্থানীয় বিট কর্মকর্তা মোজাম্মেল হককে সাময়িক বহিষ্কারের সুপারিশ করেছি।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি এবং উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী এবিষয়ে জানিয়ে ছিলেন, ‘আমি পাঁচ-ছয় দিন আগে জেনেছি বনভূমিতে আকস্মিকভাবে কে বা কারা স্থাপনা নির্মাণ করছে। শুনেছি বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের লোকজন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার আড়ালে থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য এসব অবকাঠামো নির্মাণ করছে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিধায় আমি আমার দলীয় সিনিয়র পর্যায়ে জানিয়েছি। তবে এসব নির্মাণের নেপথ্যে কে বা কারা জড়িত, তা আমি জানি না।’

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে আহমদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলে ছিলেন , ‘এ কে তো সীমান্ত এলাকা। এর ওপর রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় সরকারের কাউকে না জানিয়ে এ রকম পাকা অবকাঠামো নির্মাণের ঘটনায় আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমি ঘটনার কথা শুনেই জেলা প্রশাসকের নজরে নিয়েছি। জেলা প্রশাসক নিজেই বলেছেন, তিনিও শুনেছেন বিষয়টি। এটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন এই বিষয়ে জানিয়ে ছিলেন, ‘কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন বন বিভাগের জমি জবরদখল করে এতগুলো সেমিপাকা ঘর নির্মাণের ঘটনা অবশ্যই উদ্বেগজনক। কে বা কারা এটা করেছে, এসব বিষয়ও দেখা হবে। আমরা এ বিষয়টিকে সিরিয়াসলি দেখব। বিষয়টি আমাকে বন বিভাগীয় কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে এখানে আমার প্রশ্ন, বন বিভাগের এই জমি কি এক দিনেই দখলে নেওয়া হয়েছে আর এসব স্থাপনা কি এক দিনেই নির্মাণ করা হয়েছে?’

কক্সবাজারের উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) হাবিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলে ছিলেন, ‘কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের কথা শুনেছি। এসব স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এবং উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। আমি ও ওসি সাহেব কাল-পরশু ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাব।’

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিল্লোল বিশ্বাস বলে ছিলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনারা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখুন।’

কক্সবাজারে কর্মরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানিয়ে ছিলো, তাঁরা এ স্পর্শকাতর বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করেছেন।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমশিনারের (আরআরআরসি) কার্যালয় সূত্রে বলা হয়ে ছিলো, রোহিঙ্গা শিবিরে জাতিসংঘের চারটি সংস্থা- এইএনএইচসিআর, ডাব্লিউএফপি, ইউএনএফপিএ, আইওএম এবং স্থানীয় সাতটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কাজ করছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো হলো বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট (বিডিআরসিএস), টিএআই (টাই), আরটিএমআই, ভার্ক, হ্যান্ডিক্যাম্প ইন্টারন্যাশনাল, আরআইবি (রিভ) এবং সেভ দ্য চিলড্রেন। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক তিনটি বেসরকারি সংস্থা যথাক্রমে এমএসএফ (মেডিসিন সেন্স ফ্রন্টিয়ার্স), মুসলিম এইড এবং এসিএফ (অ্যাকশন কন্ট্রোল ফন্টেলা) সরকার ২০১২ সালে রোহিঙ্গা শিবিরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও এত দিন ধরে এনজিওগুলো সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই কাজ করেছে। তবে সম্প্রতি এসিএফ এবং এমএসএফ সরকারের কাছ থেকে আরো দুই বছর রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করার অনুমতি নিয়েছে।

টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ মুজাহিদ উদ্দিন জানিয়ে ছিলেন, মুসলিম এইডের টেকনাফ সদর অফিস সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। তবে তারা লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে সীমিত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সরকার মুসলিম এইডকে ২০১২ সালে নিষিদ্ধ করেছিল; তা এখনো বহাল রয়েছে।

রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সাবেক নেতা হাফেজ সালাউল ইসলাম জানিয়ে ছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মোটেই সত্য নয়। আমরা জঙ্গিবাদে জড়িত নই।’

২০১৫ সালের জুন মাসে যা ঘটে ছিলো :
কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়ার সেই দুর্গম পাহাড়ের অর্ধ-শতাধিক রহস্যময় স্থাপনা অবশেষে গুড়িয়ে দিয়ে ছিলো প্রশাসন। ২০১৫ সালের ৪ জুন সকালে তৎকালীন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে বিজিবি, ‌র‍্যাব, পুলিশ ও বন বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর চার শতাধিক সদস্য এ উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নিয়ে ছিলো।

ঐদিন রাত সাড়ে ৩টা থেকে শুরু হওয়া উচ্ছেদ অভিযানে দুটি বুলডোজার ব্যবহার করে অভিযানকারীরা।

এই ঘটনায় ১১৭/ উখি অব ২০১৪-১৫ তাং-০৪/০৬/১৫ ( মধুরছড়া) একটি মামলা করা হলেও ঘটনার মূল হোতা জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর ক্ষমতার দাপটের কারণে তার বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রশাসন কোন মামলা নিতে পারেনি বা করেনি। জাহাঙ্গীরের কোন কর্মকান্ডে সে সময়ের আওয়ামী লীগের উপজেলা ও জেলার নেতারা কিছু বলতে আতংকিত বোধ করতেন। এই মামলায় মাত্র ৮ জনকে আসামি করা হয়ে ছিলো। তারা হলেন আব্দুর শুকুর,নুরুল ইসলাম,মো: কালু,গফুর শামসু, সোহেল, নবী হোসেন, আনোয়ার।

স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজ মতে, সরকার দলীয় সাবেক  সাংসদ বদির শ্যালক ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে তিনি রীতিমতো একটি রাষ্ট্রের সুশৃংখল বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নেওয়া সত্বেও সেদিন তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সেই সাথে উক্ত ঘটনার অর্থ যোগান দাতা  মাল্টি-সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জুবায়ের  ও পরিচালক (সদস্য) লায়লা বেগম ও স্থানীয় সমন্বয়কারী আওয়ামী লীগ নেতা মফিজ কন্ট্রাক্টর এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি তৎকালীন প্রশাসন।

কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আলী কবির বলেছেন, সরকারি বনভূমিতে রাতারাতি অবৈধভাবে করা কোটি টাকার স্থাপনা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। এ কারণে রহস্যময় এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে বনভূমি দখল মুক্ত করা হয়েছে। দেশব্যাপী নানাভাবে আলোচিত উখিয়া-টেকনাফ আসনের সংসদ সদস্য অব্দুর রহমান বদি`র শ্যালক উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় এসব স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছিলো।

অভিযোগ ছিলো, মোটা অংকের লেনদেনে বনকর্মীদের যোগসাজশে ১৫-২০ একর সরকারি বনভূমি দখল করে জঙ্গি সম্পৃক্ত বিদেশি এনজিওর অর্থায়নে সশস্ত্র পাহারায় অর্ধ শতাধিক সেমিপাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়ে ছিলো। এর আগেও একই এলাকায় জঙ্গি সম্পৃক্ত এনজিওর অর্থায়নে এ রকম স্থাপনা স্থাপন করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা ক্ষোভ  প্রকাশ করে বলেন একটা সময় সরকার বিরোধী শক্তিদের দমন করতে জঙ্গি নাটক সাজাতেন অথচ আওয়ামী লীগ এর অনেক নেতারা গত ১৬ বছর জঙ্গি কানেকশন থাকলেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ  সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। ঘটনার দীর্ঘ নয় বছর পর নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা ঘটনার মূল হোতা, অর্থদাতা, অর্থ সংগ্রহকারী,  স্থানীয় সমন্বয়কারী এবং তাদের সহযোগী লাঠিয়াল বাহিনীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি অবৈধভাবে দখল হওয়া বনভূমি ১৫/২০ একর জমি উদ্ধারের দাবি জানিয়েছে স্থানীয় সুশীল সমাজ।

উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম জানান, উখিয়ার রাজাপালং এর মধুছড়া এলাকায় অবৈধ ভাবে এখনও বন বিভাগের জায়গায় দখল করে থাকা ডাব্লিউএফপি ও স্থানীয় ব্যক্তিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে নোটিশ ইস্যু করা হবে। পরবর্তীতে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন জানান,অভিযোগ পেলে প্রয়োজনী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


আরো খবর: