ইহরাম বাঁধার মধ্য দিয়ে হজ ও ওমরাহর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ইহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ করা। হজ ও ওমরাহ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যখন হজ বা ওমরাহ কিংবা উভয়টি পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে তালবিয়া পাঠ করে, তখন তার ওপর কিছু হালাল কাজ হারাম হয়ে যায়। এ কারণেই এ প্রক্রিয়াটিকে ‘ইহরাম’ বলা হয়।
সেই কাজগুলো হলো—
প্রথমত, মাথার চুল ছোট করা বা পুরোপুরি মুণ্ডানো। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের মাথা মুণ্ডন করো না, যতক্ষণ না পশু তার যথাস্থানে পৌঁছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৬)
তবে অসুস্থতা কিংবা ওজরের কারণে ইহরাম অবস্থায় মাথার চুল ফেলতে বাধ্য হলে কোনো পাপ হবে না, তবে তার ওপর ফিদয়া ওয়াজিব হবে। কাব ইবন উজরা (রা.) বলেন, আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে গেলাম।
তখন আমার মুখে উকুন গড়িয়ে পড়ছিল। তা দেখে তিনি বলেন, তুমি এতটা কষ্ট পাচ্ছ এটা আমার ধারণা ছিল না। তুমি কি ছাগল জবেহ করতে পারবে? আমি বললাম, না। অতঃপর নাজিল হলো, ‘আর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ কিংবা তার মাথায় যদি কোনো কষ্ট থাকে তবে সিয়াম কিংবা সদকা অথবা পশু জবেহ এর মাধ্যমে ফিদয়া দেবে।
’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৯১)
এরপর নবী (সা.) বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তাকে বলেন, ‘তুমি তোমার মাথা মুণ্ডন করো এবং তিন দিন সিয়াম পালন করো, অথবা ছয়জন মিসকিনকে খাবার দান করো নতুবা একটি ছাগল জবেহ করো।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮১৪; মুসলিম, হাদিস : ১২০১)
এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অপর এক বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন দিন সিয়াম পালন করতে হবে কিংবা ছয়জন মিসকিনকে আহার করাতে হবে। প্রত্যেক মিসকিনের জন্য অর্ধ সা (এক কেজি ২০ গ্রাম) খাবার।’ (মুসলিম, হাদিস : ১২০১)
সুতরাং মাথা মুণ্ডানের ফিদয়া তিনভাবে দেওয়া যায় : ছাগল জবেহ করা অথবা তিনটি রোজা রাখা কিংবা ছয়জন মিসকিনকে পেট পুরে খাওয়ানো।
দ্বিতীয়ত, হাত বা পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, কর্তন কিংবা ছোট করা।
আলিমরা এ ব্যাপারে একমত যে নখ কাটা ইহরাম পরিধানকারীর জন্য হারাম। হাত কিংবা পায়ের নখ-উভয়ের ক্ষেত্রে একই হুকুম। তবে যদি নখ ফেটে যায় এবং তাতে যন্ত্রণা হয় তবে যন্ত্রণাদায়ক স্থানটিকে ছেঁটে দেওয়ায় কোনো ক্ষতি নেই। এ কারণে কোনো ফিদয়া ওয়াজিব হবে না। (মানাসিকুল হজ ওয়াল ওমরাহ, পৃষ্ঠা ৪৪)
তৃতীয়ত, ইহরাম বাঁধার পর শরীর, কাপড় কিংবা এ দুটির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্য কিছুতে সুগন্ধি জাতীয় কিছু ব্যবহার করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা (ইহরাম অবস্থায়) জাফরান কিংবা ওয়ারস (এক জাতীয় সুগন্ধি) লাগানো কাপড় পরিধান করবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৩৮)
অপর এক হাদিসে তিনি আরাফায় অবস্থানকালে বাহনে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণকারী এক সাহাবি সম্পর্কে বলেন,
‘তার কাছে তোমরা সুগন্ধি নিয়ো না। কারণ তাকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে যে সে তালবিয়া পাঠ করতে থাকবে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৩৯)
তবে ইহরামের আগে ব্যবহৃত সুগন্ধির কিছু যদি অবশিষ্ট থাকে তবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। আয়েশা বলেন, ‘ইহরাম অবস্থায় আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাথার সিঁথিতে যেন মিশকের চকচকে অবস্থার দিকে তাকাচ্ছিলাম।’ (বুখারি, হাদিস : ২৭১)
চতুর্থত, বিবাহসংক্রান্ত আলোচনা করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইহরাম পরিধানকারী বিবাহ করবে না, বিবাহ দেবে না এবং বিবাহের প্রস্তাবও পাঠাবে না।’ (মুসলিম : ৫/২০৯)
পঞ্চমত, ইহরাম অবস্থায় সহবাস করা। আলিমদের ঐকমত্যে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর মধ্যে কেবল সহবাসই হজকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
ষষ্ঠত, ইহরাম অবস্থায় কামোত্তেজনাসহ স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা। যেমন চুম্বন, স্পর্শ ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি এ মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
সপ্তমত, ইহরাম অবস্থায় শিকার করা। হজ বা ওমরাহ যেকোনো অবস্থাতেই মুহরিমের জন্য স্থলভাগের প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ—এ ব্যাপারে আলিমরা একমত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর স্থলের শিকার তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাকো।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৯৬)
সুতরাং শিকারকৃত জন্তু ইহরাম অবস্থায় হত্যা করা বৈধ নয়। তবে আলিমরা প্রাণী শিকার বলতে এমন সব প্রাণী বলে একমত পোষণ করেছেন, যার মাংস মানুষের খাদ্য এবং যা বন্য প্রাণীভুক্ত। তাই ‘শিকার’ বলতে এমন সব প্রাণী বোঝায়, যা স্থলভাগে বাস করে, হালাল ও প্রকৃতিগতভাবেই বন্য। যেমন হরিণ, খরগোশ, কবুতর ইত্যাদি। এসব প্রাণীর শিকার যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি সেগুলোকে হত্যা করা এবং হত্যার সহায়তা করাও নিষিদ্ধ। যেমন দেখিয়ে দেওয়া, ইশারা করা বা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা। তবে পোষা প্রাণী জবেহ করা বৈধ। কারণ এটি শিকারের আওতায় পড়ে না। যেমন: হাঁস, মুরগি, ছাগল ইত্যাদি। আর ক্ষতিকর পোকা-মাকড় কিংবা হিংস্র প্রাণী শিকার-জন্তু হিসেবে গণ্য হবে না। সুতরাং হারাম শরিফের এলাকা কিংবা অন্য যেকোনো স্থানে তা হত্যা করা বৈধ। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) ইহরাম পরিধানকারীর জন্য হত্যা করা বৈধ এমন সব প্রাণীর উল্লেখ করে বলেন, সাপ, বিচ্ছু, ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ, চিল, পাগলা কুকুর, হিংস্র পশু। (তিরমিজি, হাদিস : ৮৩৮)
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘হারাম কিংবা হালাল উভয় এলাকায় রাসুলুল্লাহ (সা.) পাঁচ ধরনের প্রাণী হত্যা করা বৈধ বলে উল্লেখ করেছেন : কাক, চিল, বিচ্ছু, ইঁদুর ও হিংস্র কুকুর। অন্য বর্ণনায় আছে ‘সাদা কাক’। (ফাতহুল বারী : ৬/ ৫১১; শরহে মুসলিম : ৪/৩৭২)
আইএ